প্রবাস

মালয়েশিয়ায় চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা

মালয়েশিয়ায় বিপুল প্রত্যাশা আর জীবন সংগ্রামের চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। পরিবারের অভাব-অনটনের গ্লানি ও দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল করতে সাইদ, জসিম, মামুন ও গোলাম রাব্বি ছুটে আসেন স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায়। কেউ এসেছেন প্রফেশনাল ভিসায় আবার কেউবা স্টুডেন্ট ভিসায়।

Advertisement

তবে কেউই এখন প্রফেশনাল নেই। কোম্পানির অধীনে কাজ করছেন সি-ফুডে। দেশটির রাজধানী শহর কুয়ালালামপুরের বৃহৎ শপিংমল বিরজায়া টাইমস স্কয়ারে এম কিউ এস মোল্লা মেঘা সি-ফুডে কাজ করছেন ওরা চারজন। ২১ মার্চ তাদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।

বিরজায়া টাইমস স্কয়ারের আন্ডারগ্রাউন্ড পুরো ফ্লোরটাই সি-ফুডের একটি অংশ। এখানে বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা খেতে আসেন। সকাল থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত বিদেশিদের সমাগম।

মালয়েশিয়ার এ সি-ফুডগুলোতে সাইদ আর জসিমই নন। তাদের মতো আরো অনেক বাংলাদেশিরা কাজ করছেন। যারা এই কাজ করছেন প্রত্যেকেই যেন একেকজন ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ। আর এসব পরিশ্রমীরাই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিবার তথা দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রেখেছেন।

Advertisement

মুন্সীগঞ্জের মো. আবু সাইদ ও মামুন খান ২০১৫ সালে প্রফেশনাল ভিসায় সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। ঢাকা জুরাইনের গোলাম রাব্বি ও কুমিল্লার জসিম উদ্দিন ২০১৬ সালে স্টুডেন্ট ভিসায় পাড়ি জমান স্বপ্নের দেশে। পরবর্তীতে রি-হিয়ারিংয়ের আওতায় ভিসা পরিবর্তন করে এম কিউ এস মোল্লা মেঘা কোম্পানির নামে বৈধ ভিসা করেন তারা।

সাইদ, জসিম, মামুন খান ও গোলাম রাব্বি এ চারজন কাজ করে চলেছেন মোল্লা মেঘায়। তাদের মেধা ও মননশীলতায় গর্বিত মালিক। বর্তমানে সাইদদের বেতন মাসিক ১৫শ রিঙ্গিত। নিজের খরচের পর উদ্ধৃত টাকা বাবা-মাকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তারা। নানা দেশের কর্মীদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতায় কোনো অংশেই বাংলাদেশি কর্মীরা কম নন। সাইদদের কাজের দক্ষতা ও যোগ্যতায় তাক লাগিয়ে দেয় অন্যদের। এরই মধ্যে কর্তৃপক্ষের মন জয় করে নিয়েছেন এ সারথিরা।

জসিম বলেন, প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগছিল। এখন ভালোই লাগছে। মনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ থাকলেও তা পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটাতে এবং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করতে প্রবাসে শ্রম দিয়ে যাচ্ছি এটাই আমার সফলতা। ভিন দেশের মানুষের আন্তরিকতা, অগ্রজদের স্নেহ আর বন্ধুদের ভালোবাসায় আমরা নিবিড় বন্ধন গড়ে তুলেছি। সে বন্ধনটাই আসলে একটি বাংলাদেশ।

প্রবাসে জীবিকার কঠোর সংগ্রামে, সমস্যার ভারে ক্লান্ত। তারপরও কালের পরিক্রমায় নতুন আশায় স্বপ্ন দেখছেন তারা। কিন্তু সুন্দর জীবনের খোঁজে যাওয়া এই প্রবাসীরা কি আসলেই সুন্দর একটা জীবনের দেখা পায়? হয়তো কেউ পায় কেউ পায় না।

Advertisement

যখনই বাংলাদেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধির কথা আসে ঠিক তখন সবাই একবাক্যে স্বীকার করে প্রবাসী বাঙালিদের অবদানের কথা। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। কিন্তু কেমন কাটে এই প্রবাসীদের জীবন তার খবর কয়জন-ই বা রাখে? সরকারও বা কি সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে তাদের? সমাজ-ই বা তাদের কোন চোখে দেখে? সমাজের প্রতিটি স্তরে চরমভাবে অবহেলা করা হয় প্রবাসীদেরকে।

সমাজের উঁচুতলার মানুষেরা তাদের কথা শুনলে নাক সিটকায় এমনকি অনেক সময় ‘কামলা’ বলে থাকে। অথচ এই প্রবাসী মানুষটাই একটি পরিবারের শক্তি। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডের অংশীদার। শ্রমবাজারে যারা শ্রম বিক্রি করে তাদের উপার্জন হয় মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। দেশীয় আয়ে বড় অংক মনে হলেও থাকা খাওয়া আর ব্যক্তিগত খরচের পর কত টাকাই বা দেশে পাঠানো যায়। করতে হয় ওভার টাইম।

ওভার টাইমে কি করতে হয় জানেন? অনেকেরই জানা নেই। রাস্তায় কাজের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বাড়ি বাড়ি যেতে হয়। চারতলা থেকে খাট ফ্রিজ নিচ তলাতে নামাতে হয়। এটাই ওভার টাইম। অনেক প্রবাসী ওভার টাইম করে নিজের খরচটা জোগার করতে। যেন বেতনে হাত লাগাতে না হয়। প্রবাসীদের জীবনযাপন অতিসাধারণ। ওদের চলতে এতো টাকা লাগে না।

তারা টাকা না পাঠালে অনেকেরই ঘরের চুলা জ্বলে না। আবার অনেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে বিদেশে গেছেন। আসল টাকাটা দিতে না পারলেও সুদের টাকাটা অন্তত মাসে মাসে দিতে হয়। চার পাঁচ বছর কেটে যায় বিনিয়োগের টাকাটা তুলতে।

আমরা জোরসে বলে থাকি, আমার ভাই বিদেশে। আমার বাবা, মামা বিদেশে থাকেন। স্ত্রী স্বামীর কাছে আবদার সংসার চালাতে টাকা পাঠাও। সন্তান বাবাকে জানায় স্কুলের জন্য টাকা পাঠাও। একটি রঙিন টিভি পাঠাও। মোবাইল সেট আপডেটটা পাঠাও। কম্পিউটার ছাড়া চলছেই না। নানা আবদার শুনতে হয় একজন প্রবাসীকে। আমরা কখনও ভেবে দেখেছি? তারা কীভাবে টাকা অর্জন করছে। আমি যখন টাকা চাচ্ছি তখন প্রবাসী স্বজনের কাছে টাকা আছে কি না? কখনও কি ভেবেছি প্রবাসী ব্যক্তিটি কী কাজ করছে। হাতেগোনা কিছু প্রবাসীর ভাগ্যে আরামদায়ক কাজ মিললেও অনেকেই কনস্ট্রাকশনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে।

কেউ কেউ মাটির নিচে রেল লাইনের কাজ করছে। কেউ আবার আকাশচুম্বি দালানে কন্সট্রাকশনের কাজে ব্যস্ত। অথচ ফোন না ধরলেই আমরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি। আমরা কি ভেবে দেখি, আমাদের অসুস্থতায় স্বজনরা সেবায় এগিয়ে আসেন। অথচ আমাদের ওই প্রবাসী মানুষটা অসুস্থতায় কাতরাচ্ছে একা ঘরের কোণে। তার সহকর্মীও থাকতে পারছে না কাজের চাপে। তাদের শ্রমের মূল্য আমাদেরকে দিতে হবে।

ওরা আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা। তাদের পাঠানো অর্থ পরিবারের প্রয়োজনই মেটায় না, তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে এবং নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কোনো দেশের প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।

প্রবাসীদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের কারণেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশ্ব মন্দার প্রভাব তেমন একটা অনুভব হয়নি। অর্থনৈতিক গতিশীলতার ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ নিউক্লিয়াস হিসাবে কাজ করে। রেমিট্যান্স আমাদের মোট অভ্যন্তরীণ আয় বা জিডিপির ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ। জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই রেমিট্যান্স। প্রবাসী কবি বাশার খাঁন অপূর্ব বলেন, ‘প্রবাসী রেমিট্যান্স আমাদের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখায়। উন্নয়নের অংশীদার হয়। সেই রেমিট্যান্সকে বাধা প্রদান করলে দেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। এক কোটি প্রবাসী কান্না আমাদের থামাতে হবে। ওরা মিছিল করতে পারে না। কারণ ওরা প্রবাসে। এজন্য এদের অধিকার আদায় হবে না তাতো হয় না। সরকারকেই ওদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।’

দেশে উন্নয়নের এই মহাশক্তি রেমিট্যান্স যেমন দেশের জন্য প্রয়োজন ঠিক তেমনি রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের বাঁচানোও আমাদের সবার দায়িত্ব। ওদের অবমূল্যায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। বরং আমি, আপনি, সরকারকে যৌথভাবে ওদের সমস্যা সমাধান করে এই যোদ্ধাদের আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন মনে করছেন অনেকে।

এমআরএম/পিআর