আন্তর্জাতিক

শোকের শহর ক্রাইস্টচার্চে মুসলিমদের কান্না

শান্ত ছবির মতো সুন্দর শহর ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলার পর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ঘাতকের নির্বিচার গুলি বর্ষণে ৪৯ জন নিরীহ মানুষের প্রাণহানির পর পুরো শহর যেন কালো স্কার্ফ দিয়ে মোড়ানো। শোক প্রকাশের ভাষাও অনেকের জানা নেই। নীরবতাই যেন হয়ে উঠেছে সেই শোকের সর্বজনীন ও একমাত্র ভাষা।

Advertisement

শহরের হঠাৎ এই বিপর্যয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন মানুষ। শোক প্রকাশের ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন অনেকে। ব্যাথা বোঝানোর ভাষা না পেয়ে তাই সবাই নীরব হয়ে গেছেন। কথায় আছে অধিক শোকে নাকি মানুষ পাথর হয়ে যায়। বিশেষ করে যারা মুসলিম তাদের শোকের মাতম দেখলেই বোঝা যায় কতটা অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা।

মসজিদের যেখানে নৃশংস হামলার ঘটনাটি ঘটেছে তা থেকে অল্প কয়েক মিটার দূরে দেয়ালে মানুষ আসছেন। একজন একজন করে সেখানে তারা নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিচ্ছেন। সেখানে দাঁড়ানো অনেকের চোখে বিন্দু বিন্দু জল। তবে বেশিরভাগ মানুষ সেখানে গিয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকেন আর দেখেন।

আরও পড়ুন>> মসজিদে হামলাকারীর অস্ত্র কেড়ে নেন এই সাহসী তরুণ

Advertisement

তাদের মধ্যে একজন মার্ক ইসাক। তার বন্ধুও সেই মসজিদে হামলার শিকার। তবে প্রাণে বেঁচে গেলেও হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। বন্ধুকে ইসাক দেখতে পারেননি। তাকে হাসপাতালে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তবে বন্ধু যেখানে হামলা শিকার হয়েছেন সেখানে গিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছেন।

মার্ক ইসাক বলছিলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত আমাদের হাসপাতালে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। তাই এখন আমরা অপেক্ষা করছি যে তার সাথে কি ঘটে। আমি অনুভব করছি আমার কিছু করার নেই কিন্তু এখানে এসে তাকে ভালোবাসার সুযোগ তো পাচ্ছি।’

দাউদ নবী একজন আফগান অধিবাসী মসজিদে হামলার ঘটনায় নিহত হয়েছেন। ১৯৭৭ সালে নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমানো দাউদ সেখানকার একজন কমিউনিটি নেতা ছিলেন। তার ছেলে ইয়ামা আল নবী সাংবাদিকদের বলেন, ‘গোলাগুলির সময় আরেকজনের জীবন বাঁচাতে গিয়ে তিনি (বাবা) প্রাণ হারিয়েছেন।’

আল নুর মসজিদে হামলার খবর শুনে দ্রুত সেখানে ছুটে যান আল নবী। তবে তিনি দেরি করে ফেলেন। হামলাস্থলে পৌঁছানোর পর তাকে একজন এসে বলে, ‘তোমার বাবা আমার জীবন বাঁচিয়েছে।’ পরে তার ভাই ওমর তাকে নিশ্চিত করেন, হামলাকারীর ধারণ করা ভিডিওতে তিনি তার বাবার মৃত্যু দেখেছেন।

Advertisement

আরও পড়ুন>> মসজিদে হামলা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য, সিনেটরের মাথায় ডিম ভাঙল তরুণ

নিউজিল্যান্ডের হাজারো মানুষ শনিবার গণহত্যার শিকার ওই মসজিদ ও হামলাস্থলে যান। হামলার ঘটনায় নিহতদের বন্ধু ও পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন তারা। আর যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই শিশু ছিল বলে জানা যায়।

আবার অনেকেই হাসপাতালে যাচ্ছেন প্রিয়জনের খবর নেওয়ার জন্য। তাছাড়া এখনো অনেক মুসলিম নিখোঁজ রয়েছেন। আফগানিস্তান থেকে নিউজিল্যান্ডে আসা শরিফুল্লাহ নাজিব হাসপাতালের আশেপাশে তার এক বন্ধুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারও লিনউড মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজ থাকায় যেতে পারেননি।

নাজিব গার্ডিয়ানের প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা মানুষের অবস্থা দেখার জন্য এসেছি। আমরা অনেককে হারিয়েছি। আমাদের অনেক বন্ধুর নিহত হয়েছে এই হামলায়। আমরা জানি না কারা বেঁচে আছে আর কারা হাসপাতালে আছে। আমার তিনজন বন্ধু আছে ভেতরে। তারা বুলেটবিদ্ধ। আমরা এখন একটি স্কুলে যাচ্ছি যেখানে মরদহের তালিকা আছে।’

নিখোঁজদের মধ্যে তিন বছর বয়সের একটি শিশু আছে। শেষবার তাকে তার বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে আল নূর মসজিদে দেখা যায়। ১৪ বছর বয়সী আরও এক কিশোর নিখোঁজ। যার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ফুটবলার হবে। শুক্রবার সন্ধ্যায় তার পরিবার জানতে পারে যে সে আর নেই। আল নূর মসজিদে ঢোকার পর থেকেই নিখোঁজ স্থানীয় ক্যাশমেরে স্কুলের ১০ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী।

আরও পড়ুন>> এবার লন্ডনে মসজিদে হাতুড়ি নিয়ে মুসলিমের ওপর হামলা

ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখা কিশোরের বাবা বলছিলেন, ‘আমি আমার ছোট ছেলেটাকে হারিয়ে ফেলেছি। তার বয়স মাত্র ১৪ তে পড়েছে। আমি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যুর খবর পাইনি। তবে সে যে আর নেই এটা আমার জানা হয়েছে গেছে।’ এমন কথা বলতে বলতে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারেন না তিনি।

তবে যারা ওই নৃশংস হামলা থেকে বেঁচে ফিরেছেন তাদেরও হয়েছে ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতা। আদিম সামি নামের ৫২ বছর বয়সী এক বাবা নাটকীয়ভাবে তার দুই ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। মসজিদে হামলাকারী যখন নির্বিচারে গুলি করা শুরু করেন তখন তিনি তার ২৯ ও ২৩ বছর বয়সী ছেলে আবদুল্লাহ আর আলির উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাদের প্রাণ রক্ষা করেছেন। তবে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে থেকে নিজে বাঁচতে পারেননি তিনি।

হামলায় বুলেটবিদ্ধ আদিব এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তার মেয়ে বলছিলেন, ‘আমার বাবা একজন প্রকৃত নায়ক। তিনি আমার ভাইদের বাঁচাতে নিজের পিঠ বুলেটের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি তাদের সাথে কিছুই ঘটতে দেননি।’

এমন অসংখ্য ঘটনা আর প্রিয়জন হারানোর নির্মম গল্প তৈরি হয়েছে আল নূর মসজিদে হামলার ঘটনায়। কেউ ভাই হারিয়েছেন, কেউ সন্তান, তো কেউ বাবা। আবার অনেকেই স্বামী সন্তান সবই হারিয়েছেন। কট্টর খ্রিষ্টীয় ধর্মালম্বী অস্ট্রেলিয়ান সেই হামলা হামলাকারী স্পষ্টত একজন সন্ত্রাসী। আর তার পেছনে মদদ আছে খ্রীষ্টান জঙ্গিবাদের। ধর্মের নামে যা মানুষ মারার বৈধতা দেয়।

এসএ/এমকেএইচ