অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৩৩টি খাতে দুর্নীতির তথ্য সংবলিত একটি প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে হস্তান্তর করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সোমবার (১১ মার্চ) শেরেবাংলা নগরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) নিজ কার্যালয়ে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়।
Advertisement
আরও পড়ুন >> অর্থ মন্ত্রণালয়ে ৩৩ খাতে দুর্নীতি : যা বললেন অর্থমন্ত্রীদুদকের অনুসন্ধান ও পর্য়বেক্ষণ প্রতিবেদনে দুর্নীতির সম্ভাব্য ৩৩টি উৎস ও ২১টি সুপারিশ করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়সমূহে দুর্নীতির সম্ভাব্য উৎসগুলো হলো- সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীর বদলিজনিত কারণে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করার পর হিসাবরক্ষণ দফতর কর্তৃক শেষ বেতনপত্র (এলপিসি) নতুন কর্মস্থলে প্রেরণের বেলায় বিলম্ব; সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীর কর্ম অবসানে অবসরে গমনকালে সর্বশেষ হিসাবরক্ষণ দফতর কর্তৃক তার প্রত্যাশিত শেষ বেতনপত্র (ইএলপিসি) ইস্যুর ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব; কর্মকর্তাদের সার্ভিস স্টেটমেন্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে হয়রানিমুক্ত সেবা প্রদান না করা; কর্মচারীদের সার্ভিস বুক ভেরিফিকেশনের বেলায় অনিয়মিতভাবে অর্থ আদায় করা; কর্মকর্তা/কর্মচারীদের সিলেকশন গ্রেড/টাইম স্কেলে বেতন নির্ধারণের বেলায় এবং বেতন নির্ধারণের পর এরিয়ার বিল দাখিল করা হলে অনিয়মিতভাবে আর্থিক সুবিধা আদায় করা;
কর্মকর্তা/কর্মচারীদের পে-ফিক্সেশনের বেলায় অনিয়মিতভাবে আর্থিক সুবিধা প্রদানের দাবি করা; কর্মকর্তা/কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ তহবিল (জিপিএফ) হিসাব খোলার সময় অনিয়মিতভাবে অর্থ আদায় করা; কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জিপিএফ অগ্রিমের অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে অনিয়মিতভাবে আর্থিক সুবিধা আদায় করা; কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জিপিএফ হিসাব হতে চূড়ান্ত অর্থ পরিশোধের বেলায়ও অনিয়মিতভাবে আর্থিক সুবিধার দাবি করা; সরকারি বিভিন্ন অগ্রিম যথা- গৃহনির্মাণ, গাড়ি, মোটর সাইকেল, কম্পিউটার ইত্যাদির বিলের অর্থপ্রাপ্তিতে অনিয়মিত আর্থিক সুবিধা প্রদান; সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকসহ কর্মচারীদের পেনশন সংক্রান্ত আনুতোষিক (গ্র্যাচুইটি) প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনিয়মিত অর্থ প্রদান করা;
ভ্রমণ ভাতার বিল পরিশোধের জন্য একটি নির্দিষ্ট হারে অনিয়মিত অর্থ পরিশোধ করা; আনুষঙ্গিক ও অন্যান্য খাতের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হারে অনিয়মিত অর্থ প্রদান করা; শ্রান্তি-বিনোদন ভাতার বিল উত্তোলনের বেলায় অনিয়মিত অর্থ পরিশোধ করা; বিল দাখিলের ক্ষেত্রে টোকেন প্রদানের সময় হয়রানির শিকার; সরকারি চাকরিতে নবনিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের প্রথম বেতন বিলের টাকা প্রাপ্তিতে অনিয়মিত অর্থ প্রদান; ভুয়া পেনশন সংক্রান্ত বিল পরিশোধের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা; ভুয়া ভ্রমণভাতা বিল পরিশোধের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা; উন্নয়ন প্রকল্প হতে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের বেলায় অনিয়মিতভাবে অর্থ আদায় করা; সরকারি দফতরসমূহ কর্তৃক ক্রয়ের ক্ষেত্রে সংঘটিত অনিয়মসমূহের উপর যথাযথ প্রি-অডিট আপত্তি প্রদান না করে অনিয়মিত অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে বিল পাস করা;
Advertisement
সরকারি দফতর কর্তৃক সম্পদ সংগ্রহ বা ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট/আইটি/কাস্টম্স ডিউটি কর্তন না করে সরকারি রাজস্ব আদায়ের প্রতিবন্ধকতা বা বাধা সৃষ্টি এবং রাজস্ব আদায়ের টার্গেটে পৌঁছতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা; উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে অর্থছাড়ের বেলায় প্রতিবন্ধকতা, হয়রানি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অনিয়মিত আর্থিক সুবিধা গ্রহণ; জুন মাসে যথাযথ প্রি-অডিট না করে অনিয়মিত আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিল পাস করা; সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে মাসভিত্তিতে সমরূপে ব্যয় না করে অর্থবছরের শেষ প্রান্তে তথা এপ্রিল, মে, জুন মাসে অর্থছাড় ও বিল সাবমিট করা। হিসাব দফতরসমূহ কর্তৃক যথাযথ প্রি-অডিট না করে বিলসমূহ পাস করা; হিসাবরক্ষণ অফিস কর্তৃক বিভিন্ন অফিসের পে-রোলে নাই এমন ব্যক্তিদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে সরকারি অর্থের আত্মসাৎ করা;
ব্যাংক কর্তৃক পরিশোধিত মাসিক পেনশনের টাকা হিসাব অফিস কর্তৃক পুনর্ভরণের ক্ষেত্রে কখনও কখনও ভুয়া বিল বা ডুপ্লিকেট বিলের মাধ্যমে সরকারি অর্থের ক্ষতি ও আত্মসাৎ করা; সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের নিয়মিত বিলের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট অডিট আপত্তি উত্থাপন না করা; নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধের নির্দেশনা অমান্য করে সরকারি সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি করা; বরাদ্দ জটিলতা দেখিয়ে হয়রানি করা; বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও বরাদ্দ নেই বলে বিলম্ব করা ও ভোগান্তি সৃষ্ট করা; দাখিলকৃত কাগজপত্র সঠিক ও পর্যাপ্ত নয় মর্মে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা হয়। অর্থ প্রদান করলে বিল প্রদান করা; ব্যাংকে কোন কোন ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে অ্যাডভাইস প্রদান না করা; সঠিক বরাদ্দ পাওয়ার পরও অর্থনৈতিক কোড নিয়ে বিড়াম্বনা ও ভোগান্তি সৃষ্ট করা।
দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক টিমের সুপারিশমালা হলো-
সিজিএ কার্যালয় কর্তৃক মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় ভিডিও কনফারেন্স প্রযুক্তির ব্যবহার জোরদার করা; বর্তমানে হিসাবরক্ষণ অফিসসমূহে যে জনবল রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। যে কারণে সেবা প্রার্থীদের সেবা পেতে অনেক বিলম্ব হয়। সেবাপ্রার্থীর দ্রুত সেবা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল বাড়ানো; একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আইটি সেক্টর প্রতিষ্ঠা করা; আইটি সিস্টেমকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য প্রতিটি হিসাবরক্ষণ অফিসে একজনকে পদায়ন করা; ই-ফাইলিং কার্যক্রম গ্রহণ অর্থাৎ সমগ্র অফিস অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার পদক্ষেপ গ্রহণ করা; সব ধরনের বিল ইলেকট্রনিক্যালি নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা এবং কতিপয় ক্ষেত্রে (জিপিএফ অগ্রিম গ্রহণ) সেইম ডে সার্ভিস চালুকরণের ব্যবস্থা নেয়া;
Advertisement
পেপারলেস সাইভার আর্কাইভেরব্যবস্থা করা; প্রতিটি হিসাবরক্ষণ অফিসের জন্য ওয়েভসাইটে অভিযোগ পেজ যুক্ত করা; অভিযোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সহজীকরণ; ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দাখিল, শুনানি ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা থাকা; ট্রানজেকশন অ্যাকাউনটিং সিস্টেম যা পরবর্তীতে আইবিএএসে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে আইবিএসের স্থলে আইবিএস + + রূপান্তরিত হয়েছে বাজেট সন্নিবেশ, অধিকতর স্বচ্ছতা এবং নির্ভুল ও শুদ্ধ হিসাব প্রণয়নের লক্ষ্যে। সে লক্ষ্যে অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার, সুপার, অডিটরের ডেক্স-এ আইবিএস ++ কানেকটেড কম্পিউটার সরবরাহ নিশ্চিত করা; দাপ্তরিক কাজে গতিশীলতা ও সচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে কর্মকর্তা/কর্মচারীগণকে প্রতি তিন বছর অন্তর বদলির বিষয়টি শক্তভাবে অনুসরণ করা।
পেনশন সংক্রান্ত কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও দ্রুত করার লক্ষ্যে পেনশন কেস ৫-৭ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করা, পেনশন সহজীকরণ বিধিমালা বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করা; উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় মাঠপর্যায়ের অফিসগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; বেতন-ভাতাসহ সব ধরনের বিল পরিশোধের বেলায় দায়িত্ব অবহেলা ও বিলম্বের জন্য দায়ী কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে দায়-দায়িত্ব নিরূপন করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া; প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়, বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, জেলা হিসাব রক্ষণ অফিস ও উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস কর্তৃক সরকারি পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সংঘটিত অনিয়ম, দায়িত্ব অবহেলা ও দুর্নীতি মনিটরিংয়ের জন্য হিসাব মহানিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি ‘হট লাইন’ স্থাপন করা; ‘হট লাইনের’ মাধ্যমে প্রাপ্ত অভিযোগগুলো নিয়মিত পর্যালোচনা করে যথাযথ ও দৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ করা; হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, অডিটর পর্যায়ে তথা সিদ্ধান্ত প্রদানকারী পর্যায়ে স্থানীয় কর্মকর্তা/কর্মচারী নিয়োগ না দেয়া; কোন এক স্টেশনে দীর্ঘকাল অবস্থান পরিহারের লক্ষ্যে কর্মকর্তা পর্যায়ে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নিয়মিত বদলি নিশ্চিত করা।
এমইউ/এমএআর/বিএ