আন্তর্জাতিক

মুক্তি ভবন : যে হোটেলে শুধু মরার জন্য যায় মানুষ

তারা পুরনো গাড়িতে করে, ক্র্যাচে ভর দিয়ে কখনো স্ট্রেচারে শুয়ে এই হোটেলে পৌঁছান। প্রত্যেক বছর হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন আগে এই হোটেলে যান। ‘মুক্তি ভবন’ হিসেবে পরিচিত এই বাড়িটির অবস্থান ভারতের উত্তরাঞ্চলের উত্তরপ্রদেশের পবিত্র নগরী বারানসিতে।

Advertisement

বৃদ্ধ বয়সের একেবারে শেষ দিকে এসে অনেকেই বাড়িতে সেবা-যত্ন পান না। আবার মারা যাওয়ার পর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের জন্যও অনেকের কেউ নেই। তারাও যান বারানসিতে, এই আশায় যে, সেখানে গেলে শেষকৃত্যটুকু হবে। কিন্তু বারানসির ‘কাশি লাভ মুক্তি ভবন’ বা ‘পরিত্রাণ ভবনে’ জায়গা পাওয়াটা অত্যন্ত কষ্টকর।

এই ভবনে ঠাঁই পান তারা, যাদের জীবনপ্রদীপ একেবারে নিভু নিভু করছে। হয়তো কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যাবেন তারা। বারানসির ‘মৃত্যু হোটেল’ নামে পরিচিত এই বাড়িতে প্রত্যেক মাসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ২০ জন নারী-পুরুষ আসেন শুধু মারা যাওয়ার জন্য।

আরও পড়ুন : কাশ্মিরকে আলাদা করার প্রস্তাব, গণ-অসহযোগ আন্দোলনে স্থানীয়রা

Advertisement

ঔপনিবেশিক আমলের লাল রঙয়ের মলিন এই ভবনে ১২টি রুম রয়েছে। হিন্দুরা মনে করেন, ‘বারানসিতে মারা যাওয়ার ফলে জীবন ও মৃত্যুর পুনরুত্থানের অনন্ত চক্র থেকে মুক্তি পান তারা।’ সেই সঙ্গে গঙ্গায় শবদাহ তাদের বাড়তি বোনাস।

বারানসিতে মুক্তি ভবনের মতো আরো অনেক গেস্ট হাউস আছে। কিন্তু সেই হোটেলগুলো পর্যটকদের জন্য স্বাভাবিক হোটেলের মতো। ২৪ ঘণ্টা শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের মাঝে জেগে থাকা এই নগরীতে যা বিপুল পরিমাণের বাড়তি অর্থ যোগ করছে।

মুক্তি ভবনের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে গত চার দশক ধরে দায়িত্ব পালন করছেন ভৈরব নাথ শুকলা। তিনি বলেন, এই ভবনে আসা অতিথিরা মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে মারা যান। তবে স্বাভাবিকভাবে একজন অতিথি মাত্র দুই সপ্তাহ ধরে একটি রুম ব্যবহার করতে পারেন।

আরও পড়ুন : ইরানে আত্মঘাতী হামলায় ২৭ রেভোলিউশনারি গার্ড নিহত

Advertisement

মুক্তিভবনের প্রবেশপথের সামনে প্রতিনিয়ত দেখা যায় শুকলাকে। তিনি বলেন, ‘তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। কিছু মানুষ আসলেই অসুস্থ্য, কিন্তু এক সপ্তাহের বেশি সময় পরও বেঁচে থাকেন।’

‘মাঝে মাঝে আমরা তাদের বাড়িতে ফিরে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের ডেকে পাঠাই এবং পরবর্তীতে আসার অনুরোধ জানাই। কখনও কখনও আমরা তাদের অনেক সময় থাকতে দেই।’ বারানসিতে ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের কারণে মুক্তি ভবন থেকে নদীর দৃশ্য আর দেখা যায় না। এই ভবনটি স্থানীয় একটি দাতব্য সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত হয়। কিন্তু সেখানে মরতে চাওয়া দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রচুর।

অনেকেই হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে, অনেকেই বিমানে করে অন্য দেশ থেকে, এমনকি গাড়ির পেছনে বসে ভারতের বিচ্ছিন্ন এই গ্রামে এসে পৌঁছান। দিনে একটি রুম ও বৈদ্যুতিক পাখার জন্য ভাড়া গুনতে হয় মাত্র এক ডলার।

আরও পড়ুন : বাড়ি ফিরতে চান আইএসে যোগ দেয়া ব্রিটিশ তরুণী

এছাড়া প্রত্যেক দিন ধর্মীয় কাজ-কর্ম সারার জন্য একজন হিন্দু যাজক রয়েছেন; তিনি অবশ্য অতিথিদের মাঝে গঙ্গার পানি বিতরণ করেন। হিন্দুরা এই পানিকে পবিত্র এবং বিশুদ্ধ মনে করেন।

অতিরিক্ত অর্থ থাকলে ভাড়ায় গায়ক পাওয়া যায়। যারা অসুস্থ্য অতিথিদের পবিত্র গান গেয়ে শোনান। শুকলা বলেন, ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের বর্ণের মানুষ এখানে আসেন। তারা আসেন পূর্ব, দক্ষিণ, উত্তরপূর্ব ভারত এমনকি বিদেশ থেকেও। অনেকেই আসেন তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে; যারা স্বজনের শেষ নিঃশ্বাসের জন্য অপেক্ষা করেন।

শুকলার মতে, মুক্তি ভবনে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার মানুষ মারা গেছেন। ১৯০৮ সালে এই ভবন চালু হওয়ার পর থেকে তাদের সবার শেষকৃত্য হয়েছে গঙ্গায়।

সূত্র : এএফপি।

এসআইএস/জেআইএম