জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন নারী নেত্রীরা। সরাসরি নির্বাচিত না হওয়ায় জবাবদিহিতা ও নারীদের রাজনৈতিক ভূমিকা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের ভোটকে সামনে রেখে এ দাবি আরও জোরালো হয়। এবারও সরাসরি ভোট হচ্ছে না। দলীয়ভাবে মনোনীতরাই চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হতে যাচ্ছেন।
Advertisement
একাদশ সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য জমা দেয়া ৪৯ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে গতকাল মঙ্গলবার সবগুলোকে বৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যত আসন, ততগুলোই মনোনয়ন বৈধ হওয়ায় সব প্রার্থীকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে বলে জানান রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাসেম।
তিনি বলেন, ‘সংরক্ষিত আসনে আমরা ৪৯টি মনোনয়নপত্র বাছাই করেছি। বাছাইয়ে কোনো মনোনয়নপত্র বাতিল হয়নি। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৬ ফেব্রুয়ারি যদি কেউ প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করে, তাহলে ১৭ তারিখেই আমরা চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করব।’
একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত ৫০টি আসনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগের ৪৩ জনসহ অন্য চারটি রাজনৈতিক দলের ৪৯ জনের মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশনে বৈধতা পায়। অন্যটি বিএনপি জোটের জন্য রাখা হয়েছে।
Advertisement
সংরক্ষিত আসনের নির্বাচন নিয়ে নারী নেত্রীদের ভাষ্য, সংরক্ষিত আসনগুলোতে নির্বাচন হচ্ছে না, হচ্ছে মনোনীত। আসনগুলোকে সংসদের অলঙ্কার হিসেবে বলে নারীদের বিষয়ে বৈষম্যমূলক চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। নির্বাচনী আসনভিত্তিক শুধু নারীদের ভোটে এ আসনগুলোতে নির্বাচন হওয়া উচিত স্থানীয় সরকারগুলোর মতো। সরাসরি নির্বাচিত না হওয়ায় জবাবদিহিতা ও নারীদের রাজনৈতিক ভূমিকা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করা নেত্রীরা।
তারা বলছেন, সারাদেশের সাধারণ নির্বাচনগুলোতে অন্তত ৩৩ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ নারীদের মনোনয়ন দেয়া উচিত। সেটা স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদের আসনভিত্তিক। অথবা সংরক্ষিত আসনের ক্ষেত্রে নারীদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন হওয়া উচিত বলেই মনে করেন তারা।
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন হওয়ায় এবং এ সব আসনে মনোনীত হওয়ায় সংসদ সদস্য হয়েও নারীরা রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন নারী নেত্রীরা।
জানা গেছে, নারীর ক্ষমতায়ন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ৩০০ নির্বাচনী এলাকায় প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি একটি উপধারায় ১০ বছরের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত করা হয়। এ সংরক্ষিত আসনগুলোতে পূর্ববর্তী সদস্যদের দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হবেন বলে বিধান ছিল। ১৯৭৮ সালের সামরিক ফরমান দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র ৬ নম্বর সংশোধন আদেশ ১০ বছরকালের জায়গায় ১৫ বছর ও নারীদের সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৩০টি।
Advertisement
জানা গেছে, অষ্টম সংসদে ২০০৪ সালে সংবিধানের দশম সংশোধনীতে নারী আসন সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ৪৫। একইসঙ্গে আসনগুলো সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়। নবম সংসদে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়। দশম সংসদে ২০১৮ সালে আসন সংখ্যা ৫০ রেখে ২৫ বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০৪৪ সাল পর্যন্ত করা হয়।
জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান না রেখে আরও ২৫ বছর বহাল রাখায় ওই সময়ে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের নারী জনপ্রতিনিধিরা যদি সরাসরি নির্বাচিত হতে পারেন তাহলে জাতীয় সংসদেও নারীরা পারবেন। নারীরা যেমন হিমালয়ের চূড়ায় উঠেছে তেমনি সবক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা ও আন্তরিকতার স্বাক্ষর রেখেছে। কিন্তু সেই নারীরাই আজ রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে। রাজনীতিতে নারীদের একটি অংশকে পেছনে রেখে কখনোই টেকসই উন্নয়ন হবে না।’
তিনি বলেন, ‘নারীর নির্বাচনী এলাকা নেই বলেই তারা পরনির্ভরশীল শক্তি হিসেবে রাজনীতিতে তৈরি হচ্ছে। অথচ শাসনতন্ত্র সংশোধন করে যদি নির্বাচনী এলাকা ঢেলে সাজানো যেত তাহলে এতদিনে নারীর জন্য নির্বাচনী এলাকা তৈরি হতো। সরকার ও রাজনীতিতে নারীর পদায়ন নয়, প্রকৃত অর্থে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন দরকার।’
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থার বিষয়টি সরকারকে আবারও পুনর্বিবেচনা করার কথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশে নারীদের উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে ২০১২ সালে ড. নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্থ ও উপমা দাশগুপ্তের যৌথভাবে লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়। সূচিপত্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘নারী ও বাংলাদেশ’নামে ওই বইটিতে বলা হয়েছিল, গ্রামীণ পর্যায়ে ৮৪ শতাংশ এবং শহরে ৫৯ শতাংশ নারী অবৈতনিক গৃহপরিচালিকা হিসেবে কর্মরত থাকে। বাংলাদেশে নারীরা পুরুষের তুলনায় সপ্তাহে গড়ে ২১ ঘণ্টা বেশি কাজ করে।
ওই বই থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তির সংখা ২ কোটি ৫০ লাখ। ১০ হাজার জন প্রশাসনিক কাজ করে। প্রায় ৭৯ শতাংশ নারী কাজ করে কৃষিখাতে (মৎস ও বনায়নসহ) ৯ দশমিক ৯ শতাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিবহন খাতে, ২ দশমিক ২ শতাংশ বিপণন কাজে ও শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ করনিক কাজে নিয়োজিত।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যানে পদে নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১১০ জন, জয়লাভ করেছিলেন ২৩ জন। ২০১৪ সালে ৪৫৮ ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা ছিল এক হাজার ৫৬০ জন। ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচনে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদে মাত্র ২৯ জন চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ও কর্মসংস্থানের হার ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে, যা ২০১৫ সালে এসে ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই ঋণ বিতরণের অনুপাত ২০১০ থেকে ২০১৫ সালে ৪ দশমিক ৪৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৬ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে নারীদের এসএমই ঋণের অনুপাত ৪ শতাংশের বেশি হয়নি। ফলে ২০১৫ সালে নারী উদ্যোক্তাদের গড় ঋণের পরিমাণ পুরুষ উদ্যোক্তাদের ঋণের পরিমাণের মাত্র এক-দশমাংশ।
নিজেরা করির সম্পাদক খুশি কবীর বলেন, ‘প্রত্যেক নির্বাচনে অন্তত পক্ষে ৩৩ শতাংশ নারীদের মনোনয়ন দিতে হবে। এ মনোনয়ন যদি কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ দেয়া হতো তাহলে কিন্তু সংরক্ষিত আসনের আলাদাভাবে দরকার হতো না।’
তিনি বলেন, ‘সংরক্ষিত আসন যদি রাখতেই হয় অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে। আমি মনে করি সরাসরি আসনগুলো থেকে ৫০ ভাগ নারীদের মনোনয়ন দেয়া উচিত। যদি তা না হয় তাহলে ওই ৩৩ শতাংশ অন্তত দেয়া উচিত।’
এইউএ/এনডিএস/এমকেএইচ