অনেকটাই ‘ফুটপাত পণ্যের’ মেলায় রূপ নিয়েছে এবারের ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। মেলার পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ যেদিকেই যান, কানে ভেসে আসবে- ‘দেইখ্যা লন, বাইছা লন, একদাম দেড়শ’ -এমন হাঁকডাক। রাজধানীর ফুটপাত মার্কেট সম্পর্কে যাদের সামান্যতম ধারণা আছে, তাদের কাছে এ দৃশ্য দেখে মনে হবে এটা যেন গুলিস্থান, মতিঝিল অথবা ফার্মগেটের কোনো ফুটপাতে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা।
Advertisement
দেশের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘ মেয়াদি বাণিজ্য মেলা এভাবে ‘ফুটপাত পণ্যের’ মেলায় রূপ নিলেও তা নেতিবাচকভাবে দেখছেন না খোদ মেলার আয়োজক সংস্থা রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। বরং সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য মেলায় পণ্য আসছে এমনটি ধরে নিয়ে তা ইচিবাচকভাবে দেখছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আয়োজক সংস্থাটি। অবশ্য ইপিবির পক্ষ থেকে এটাও বলা হচ্ছে- মেলায় যাতে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য আসে, সে জন্য ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।
ইপিবি’র উপসচিব ও মেলার সদস্য সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রফ এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, মেলায় ফুটপাতে বিক্রি হওয়া পণ্য আসছে, ঠিক আছে। কিন্তু মান যদি ভালো থাকে, মানুষ যদি কেনে, ক্রেতার যদি চাহিদা থাকে, আপনি বন্ধ করবেন কীভাবে? চাহিদা আছে বলেই তো সরবরাহ হচ্ছে। ওই জিনিসটা কেনার জন্যও কিন্তু এক শ্রেণির দর্শনার্থী আসেন এখানে (বাণিজ্য মেলা)। তা না হলে তো এখানে দোকানটা বসতো না।
‘এতে বোঝা যাচ্ছে, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কেনার মতো জিনিস এখানে আসে। এটাকে আমরা পজেটিভলি দেখি, নেগেটিভলি দেখি না। তবে আমরা উৎসাহিত করবো আমাদের ভালো পণ্য, যেগুলো বিদেশে প্রতিযোগীতা করতে পারবে, সেগুলো যাতে বেশি আসে’ -বলেন মোহাম্মদ আব্দুর রফ।
Advertisement
বাণিজ্য মেলার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক মানের পণ্যসামগ্রী প্রদর্শন করবেন- এমন লক্ষ্য নিয়েই রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ১৯৯৫ সালে বসে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। মাসব্যাপী এ মেলায় বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান, ইরান, জাপান, চিন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও দেশের প্রতিষ্ঠানের নামে মেলায় পণ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে।
দেশি-বিদেশি পণ্যসামগ্রী প্রদর্শন, রফতানি বাজার অনুসন্ধান এবং দেশি-বিদেশি ক্রেতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে এ মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিল্পপণ্য ও ভোগ্যপণ্য উত্পাদনকারীরা একদিকে তাদের উত্পাদিত পণ্যের গুণগত মান, ডিজাইন, প্যাকেজিং ইত্যাদি প্রদর্শন ও বিপণন করতে পারবেন, অন্যদিকে পারস্পরিক সংযোগ স্থাপনসহ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের সুযোগ লাভ করবেন, এটা ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
তবে গত এক দশক ধরে মেলার ‘বিষফোড়া’ হিসেবে দেখা দিয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠানের নিম্নমানের পণ্য নিয়ে আসা ও ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করা। এর পাশাপাশি আছে হকারদের লাগামহীন উৎপাত। তবে এবারের বাণিজ্য মেলা অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক মানের পণ্য তো দূরের কথা, গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান বাদে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই বিক্রি হচ্ছে ফুটপাতের মানের পণ্য। যেকোনো পণ্য ১৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে- এমন প্রতিষ্ঠান মেলার সবদিকেই রয়েছে। এমনকি বিদেশিদের নামে যে স্টল রয়েছে সেখানেও বিক্রি হচ্ছে নিম্ন মানের দেশি পণ্য।
মেলা প্রাঙ্গণে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আরিফুল ইসলাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি আগে কখনও ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় আসিনি। এবারই প্রথম আসলাম। গুগলে সার্চ দিয়ে উইকিপিডিয়ার তথ্যে দেখলাম- এ মেলা দেশি-বিদেশি পণ্যসামগ্রী প্রদর্শন, রফতানি বাজার অনুসন্ধান এবং দেশি-বিদেশি ক্রেতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে আমার ধারণা ছিল- মেলায় আন্তর্জাতিক মানের পণ্য থাকবে। কিন্তু মেলায় এসে হতবাক হয়েছি। এখানকার বেশিরভাগ পণ্য মনে হচ্ছে গুলিস্তান-চকবাজারের পণ্য। একটি আন্তর্জাতিক মেলায় এভাবে নিম্ন মানের পণ্য আসলে মেলার মান ও আকর্ষণ নষ্ট হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষের উচিত এদিকে নজর দেয়া।
Advertisement
মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, মেলার বেশ কয়েকটি স্টল থেকে বিক্রেতারা হাতে মাইক নিয়ে তালে তালে ‘দেইখ্যা লন, বাইছা লন, একদাম দেড়শ’ -এমন হাকডাক দিচ্ছেন, আর উৎসুক ক্রেতা-দর্শনার্থীরা তাদের চারপাশ ঘিরে তা উপভোগ করছেন। সেই সঙ্গে স্টলের ভিতরে ঘুরে ঘুরে দেখছেন বিভিন্ন পণ্য। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে- শোপিস, খেলনা গাড়ি, ট্রেন, বিল্ডিং, খেলনা পিস্তলের পাশাপাশি রান্না করার ফ্রাইপেন, কারি কুকার, পিঠা বানানোর সাচ, পানির বোতলসহ বিভিন্ন পণ্য।
১৫০ টাকার এই স্টলের পাশাপাশি বিদেশিদের নামে যেসব প্যাভিলিয়ন রয়েছে তার বেশ কয়েকটিতে বিক্রি হচ্ছে চকবাজার, বঙ্গবাজার, নিউমার্কেট ও গাউসিয়ার পণ্য। তবে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটের তুলনায় মেলার এসব স্টলে পণ্যের দাম তুলনামূলক বেশি। বিদেশি প্যাভিলিয়নের পাশাপাশি দেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও নিম্ন মানের ‘ফুটপাত পণ্য’ বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ৫৯৯ টাকায় তিন সেট থ্রি-পিস, ইলেকট্রিক সামগ্রী একটি কিনলে দশটি ফ্রি’র মতো অফার।
কথা হয় বেশ কয়েক বছর ধরে বাণিজ্য মেলায় নিয়মিত পরিবার নিয়ে আসা মোশারফ হোসেন নামের এক দর্শনার্থীর সঙ্গে। তিনি বলেন, এটি একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। স্বাভাবিকভাবেই এখানে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য নিয়ে আসার কথা ব্যবসায়ীদের। কিন্তু মেলার যেদিকেই যাই, চোখের সামনে ভেসে উঠছে স্টলের ওপর বড় করে লিখে রাখা- যেকোনো পণ্য ১৫০ টাকা। একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার এমন চিত্র কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। শুধু ১৫০ টাকার স্টল নয় মেলার সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানেই নিম্ন মানের পণ্যে সয়লাব।
তিনি বলেন, ২০১৩ সাল থেকে আমি প্রতিবছরই বাণিজ্য মেলায় পরিবার নিয়ে একাধিক দিন এসেছি। কিন্তু এবার মেলা প্রাঙ্গণে যে হারে ফুটপাত পণ্যের পসরা বসানো হয়েছে, অতীতে এমন দেখিনি। আমার যতদূর মনে পড়ে গত বছর ১৫০ টাকার স্টল ছিল একটি। এবার তো ১৫০ টাকার স্টল গুণেই শেষ করা যাচ্ছে না। ফুটপাতের পণ্য নিয়ে যে মেলার আয়োজন করা হচ্ছে, সেই মেলায় প্রবেশ করতে ৩০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হচ্ছে। এ যেন খাজনার থেকে বাজনা বেশি।
ক্রেতা-দর্শনার্থীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে ইপিবির উপসচিব ও মেলার সদস্য সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ঠিক আছে। তবে এর কনসেপ্টটা আমাদের বুঝতে হবে। এটা আসলে বারোয়ারি মেলা, যদিও নাম আন্তর্জাতিক মেলা। এখানে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব পাওয়া যায় বলে এত মানুষ আসে। এটা কনজুমার ফেয়ার, এটাকে সোর্সিং ফেয়ার বলা যাবে না। সোর্সিং ফেয়ার হলো ইন্টারন্যাশনাল ফেয়ার।
‘সোর্সিং ফেয়ার যেমন- শুধু ফার্নিচার ফেয়ার হলো, কম্পিউটার, ইলেকট্রিক ফেয়ার হলো। বিদেশি লোক আসলো, তখন এগুলো আর থাকবে না। এখানে এটা (বাণিজ্য মেলা) একটা মিলনমেলা বলা যায়। সব ধরনের পণ্যের সমাগম ঘটে যে কারণে লাখ লাখ লোক হয়’ বলেন বাণিজ্য মেলার সদস্য সচিব।
এমএএস/এমবিআর/পিআর