সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেয়া হয়েছে। বুধবার বেলা পৌনে ১১টায় তার মরদেহ সেখানে নেয়া হয়। সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মরদেহ শহীদ মিনারের বেদিতে রাখা হয়েছে।
Advertisement
গুণী এই শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে আগে থেকেই নানা পেশার অসংখ্য মানুষ জড়ো হয়েছে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। ফুল হাতে শ্রদ্ধাতে জানাতে হাজির হয়েছেন এক সময় তার সঙ্গে কাজ করা সঙ্গীত, চলচ্চিত্র অঙ্গনেরও অনেকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বুলবুলের সঙ্গে পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হন কাজী জিয়াউল ইসলাম মাহবুব। তিনি বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে আটক হয়েছিলাম যুদ্ধের সময়। ও (বুলবুল) মুক্ত হয়েছিল, আমিও মুক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে রেখে ও দুনিয়া থেকে মুক্তি নিল। এটা মেনে নেয়া বেদনাদায়ক।’
মঙ্গলবার (২২ জানুয়ারি) ভোর ৪টার দিকে আফতাবনগরের নিজ বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৬৩ বছর বয়সী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
Advertisement
সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বুলবুলের মরদেহ দুপুর ১২টা পর্যন্ত শহীদ মিনারে রাখা হবে। দেয়া হবে রাষ্ট্রীয় সম্মান। বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি)। সেখানেও তার জানাজা হবে। এরপর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে।
২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ট্রাইবুনাল গঠিত হলে তাতে স্বাক্ষ্য দেন এই মুক্তিযোদ্ধা। এরপর খুন হন তার ভাই মিরাজ। ভাই খুন হওয়ার পর থেকে পুলিশি পাহাড়ায় অনেকটা গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় চলতে চলতে একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। অসুস্থ হয়ে পড়ার বিষয়ে গত বছরের ১৫ মে তার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
তাতে তিনি লেখেন, ‘সরকার এর নির্দেশেই ২০১২ তে আমাকে যুদ্ধ অপরাধীর ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় সাক্ষী হিসাবে দাঁড়াতে হয়েছিল। সাহসিকতার সাথে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে হয়েছিল ১৯৭১ এ ঘটে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলখানার গণহত্যার সম্পূর্ণ ইতিহাস। আর, ওই গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া পাঁচজনের মধ্যে আমিও একজন। হত্যা করা হয়েছিল একসাথে ৪৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে।
Advertisement
কিন্তু, এই সাক্ষীর কারণে আমার নিরপরাধ ছোটো ভাই মিরাজ খুন হয়ে যাবে এ আমি কখনওই বিশ্বাস করতে পারিনি। সরকারের কাছে বিচার চেয়েছি, বিচার পাইনি। আমি এখন ২৪ ঘণ্টা পুলিশ পাহারায় গৃহবন্দি থাকি, একমাত্র সন্তানকে নিয়ে। এ এক অভূতপূর্ব করুণ অধ্যায়। একটি ঘরে ৬ বছর গৃহবন্দি থাকতে থাকতে আমি আজ উল্লেখযোগ্য ভাবে অসুস্থ। আমার হার্টে ৮টা ব্লক ধরা পড়েছে, এবং Bypass Surgery ছাড়া চিকিৎসা সম্ভব না।…’
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’, ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে’, ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’, ‘আম্মাজান’ প্রভৃতি।
তার সুর করা গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’, ‘সেই রেল লাইনটার ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে’, ‘একতারা লাগে না আমার দোতরাও লাগে না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে’, ‘সুন্দর, সুবর্ণ, তারুণ্য, লাবণ্য’ ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না’ প্রভৃতি। এ ছাড়াও তার লেখা, সুর করা ও গাও অসংখ্য গান রয়েছে।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
পিডি/এমবিআর/এমকেএইচ