মতামত

স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনতে আমাদের করণীয়

 

স্বাস্থ্যখাতে সরকারের যেমন অসামান্য সাফল্য আছে তেমনিভাবে অনেক ধরনের আলোচনা এবং সমালোচনাও আছে। অতীতের সাফল্যকে ধরে রেখে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আরো গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য এ আলোচনা এবং সমালোচনাগুলোকেও এখন তাই ভাবনার ভেতরে নিতে হবে। একজন চিকিৎসক এবং শিক্ষক হিসেবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য আমার তিনটি সুনির্দিষ্ট মতামত তুলে ধরতে চাই।

Advertisement

প্রথমেই চাই, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরো জনবান্ধব হয়ে উঠুক। আর এ জন্য কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিকগুলোকে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলা হোক। চিকিৎসা, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং পরিবার পরিকল্পনায় কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিকগুলোর ভূমিকা হতে পারে অসামান্য।

বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করেছে প্রতিটি গ্রাম হবে একটি শহর। এর মানে হচ্ছে শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে যাবে। মনে রাখতে হবে শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে গেলে কায়িক শ্রমের পরিমাণ কমে আসবে। জীবন আয়েসী হয়ে উঠবে অনেক।

আর এ আয়েসী জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ দিনকে দিন বাড়ছেই। অসংক্রামক এ রোগগুলো এখন রীতিমতো ভয়াবহ নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে। অথচ আমরা যদি মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারি, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে পারি তাহলে কিন্তু উক্ত রোগের হাত থেকে সহজেই রেহাই পেতে পারি।

Advertisement

কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিকগুলোতে তাই যে সকল চিকিৎসক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন তাদেরকে অবশ্যই অসংক্রামক এ রোগসমূহের চিকিৎসার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ এবং বিস্তার ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং এবং নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। কারণ জনসচেতনতাই পারে এ রোগের বিস্তার প্রতিরোধ করতে।

দ্বিতীয়ত, সরকার প্রতিটা জেলায় একটা করে সরকারি মেডিকেল কলেজ এবং বিভাগীয় শহরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে চাইছে। এটা ভালো উদ্যোগ-নিঃসেন্দেহে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করলেই হবে না। সেখানে প্রয়োজনীয় দক্ষ চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশয়ান, যন্ত্রপাতি এসবেরও ব্যবস্থা করতে হবে।

দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, নতুন নতুন যেসব মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে ব্যাপকভাবে। বিশেষ করে বেসিক বিষয়গুলো যেমন অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, প্যাথলজি,মাইক্রোবায়েলজি,ফার্মাকোলজি, ফরেনসিক মেডিসিন ইত্যাদি বিষয়গুলোতে চিকিৎসকের সংখ্যা একদম অপ্রতুল।

বিশেষ করে অ্যানাটমি এবং ফরেনসিক মেডিসিনে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত (প্রথম প্রতিষ্ঠিত ১৩ টি মেডিকেল কলেজ বাদ দিলেও) এসব মেডিকেল কলেজে শিক্ষক নেই বললেই চলে। তাহলে এমত অবস্থায় কিভাবে এসব মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা নবীন চিকিৎসকরা দক্ষ এবং যোগ্য হয়ে উঠবে?

Advertisement

সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষক স্বল্পতা কাটাতে তাই সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে “ল্যাটারাল এন্ট্রি” মানে এ সকল সাবজেক্টে কর্মরত চিকিৎসক; যাদের উচ্চতর ডিগ্রি আছে এবং বেসরকারি বা আধাসরকারি চাকরিতে নিয়োজিত আছেন তাদেরকে নিয়োগ (পূর্ণকালীন/খণ্ডকালীন/স্থায়ী) দেয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ এসব বিশেষায়িত বিষয়। ফলে এ সকল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগে তাই নিয়োগ প্রক্রিয়াতে আলাদা ধারা সংযোজন করে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করার চিন্তা করা যেতে পারে। অথবা অন্য কোনো করণীয় নির্ধারণ করে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

নতুন করে প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে অনেক ব্যাচ এরই মধ্যে বের হয়ে গেছে প্রয়োজনীয় শিক্ষক ছাড়াই। এ অবস্থা আরো চলতে থাকলে আমাদের জন্য তা হবে চরম দুর্ভাগ্যজনক। অথচ দীর্ঘসময় ধরেই এ ব্যাপারটা কিন্তু ঘটে চলেছে। তাই মেডিকেল কলেজে বেসিক এ সব বিষয়ে শিক্ষক সংকট কাটাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দ্রুত উদ্যোগী হতে হবে সকল বাধা মোকাবেলা করেই।

তৃতীয়ত, চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য রোগী এবং চিকিৎসা সুরক্ষা আইন পাস করতে হবে। এ আইনটি যতদূর জানি প্রক্রিয়াধীন। সেটা যত দ্রুত সম্ভব পাস করা উচিত। তাহলে চিকিৎসা সংক্রান্ত গাফিলতি নিয়ে রোগীরা প্রয়োজনীয় প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ পাবেন। চিকিৎসকরাও তাদের নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারবেন। তাহলে রোগী এবং তাদের স্বজন দ্বারা হাসপাতাল বা ক্লিনিকে অযথা ভাংচুর, মারামারি কমে আসবে।

আর একটা বিষয় হচ্ছে, চিকিৎসা সংক্রান্ত গাফিলতি বা ম্যালপ্রাকটিসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমএন্ডডিসি) অনলাইনে অভিযোগ গ্রহণ করার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। তাহলে রোগীরা দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে প্রাথমিক অভিযোগ দায়ের করতে পারবে।

মানুষ যদি বুঝতে পারে যে চিকিৎসা সংক্রান্ত ভুল বা গাফিলতি হলে তা নিয়ে অভিযোগ দায়ের করা যায় সহজেই এবং নিরপেক্ষভাবে তা নিষ্পত্তিও হয় তাহলে চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরে মানুষের আস্থা ফিরে আসতে সময় লাগবে না।

অসাধু চিকিৎসকরাও তাহলে সতর্ক হয়ে যাবে। যা ইচ্ছে তা করার আর সাহস পাবে না। মধ্যম আয়ের দেশ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের পথে পা বাড়াতে হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প কি কিছু আছে?

সবশেষে বলব, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উন্নতির জন্য আরো অনেক কিছু করার আছে আমাদের। যেমন আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিয়ে চিকিৎসকদের ভেতরে দুঃখ আছে। যাই হোক, সব কথা লিখতে গেলে লেখার আকার অনেক বড় হয়ে যাবে।

পরে হয়ত আবার লেখা যাবে এ নিয়ে। মোটা দাগে উপরের তিনটি বিষয় আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সেগুলোই তুলে ধরলাম এবং সমাধানের আশায় রইলাম।

লেখক: চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/এমএস