তার সমসাময়িক, সম বয়সী, সহযোগী, এমনকি বয়সে ছোট ক্রিকেটারদের মধ্যে যাদের গাড়ি আছে, তারাও প্রায় সবাই গাড়ি ড্রাইভ করে, না হয় প্রাইভেটকারে চেপেই হোম অফ ক্রিকেট মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে আসেন। ব্যতিক্রম শুধু একজন; মাশরাফি বিন মর্তুজা।
Advertisement
ঈদ-পার্বন আর জাতীয় দলের সাথে বিদেশ সফরে যাওয়ার সময় ছাড়া বছরে তিনি যে ক’দিন শেরে বাংলায় আসেন, সেটা গাড়িতে করে নয়, মোটরসাইকেলে চেপে। ভাববেন না, কারো পিছনে বসে। মাশরাফির অভিধানে কারো মোটরসাইকেলের পিছনে বসাবসি নাই বললেই চলে। তিনি শেরে বাংলা কেন, বিকেএসপিতে ক্লাব ক্রিকেটের ম্যাচও খেলতে যান মোটরসাইকেল চালিয়ে, উল্কার গতিতে।
কেউ কেউ হয়তো ফোড়ন কেটে বলবেন, থাকেন মিরপুরেই; পল্লবি সিটি ক্লাব লাগোয়া বাসা। ভৌগলিক দূরত্ব যেহেতু খুব কম, তাই মোটরসাইকেলে চেপেই শেরে বাংলায় চলে আসেন নড়াইল এক্সপ্রেস। শুধু শেরে বাংলার কথা বলা কেন, বিকেএসপিতে প্রতি বছর ৫-৭ বার ক্লাব ক্রিকেটের ম্যাচও খেলতে যান ওই মোটরসাইকেল চালিয়েই।
আসলে তা নয়। মোটরসাইকেল চালানো তার প্রিয় শখগুলোর একটি। তাই নড়াইল থেকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম শেরে বাংলায় আসলেন সেই মোটরসাইকেল চালিয়েই। একদম আগের মতোই। এসেই এর-ওর সাথে করমর্দন, সৌজন্যতা বিনিময়, হাসি-ঠাট্টা, খুনসুটি আর সাংবাদিকদের সাথে ‘অফ দ্য রেকর্ডে’ পূর্বের সেই নির্মল আড্ডা- সবই চললো আগের মতোই।
Advertisement
‘এমপি মাশরাফি’ আজ দুপুরে আসছেন মিরপুর স্টেডিয়ামে- এ খবর আগেই চাউর হয়ে গিয়েছিল শেরে বাংলায়। তারও আগে ঢাকা ডায়নামাইটস, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স আর সিলেট সিক্সার্সের অনুশীলন চলছিল মিরপুর স্টেডিয়াম লাগোয়া একাডেমি মাঠে।
বেলা পৌনে দুইটার কয়েক মিনিট আগে শেরে বাংলায় বিসিবি একাডেমি মাঠের বারান্দা- করিডোর দিয়ে ঢুকতেই সংবাদকর্মী আর ফটো সাংবাদিক ও টিভির ক্যামেরার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলেন মাশরাফি। তাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাতে, একটু শুভেচ্ছা বিনিময় করতে সবাই উন্মুখ হয়েই ছিলেন। ঠিক ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত না হলেও উপস্থিত ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফ, বিসিবি স্টাফ, টিম বয়, বিপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজি বয় আর সাংবাদিক- সবার মধ্যমনি হয়েই থাকলেন মাশরাফি।
সবাইকে একটু-আধটু সময় দিয়ে আগের মত কথা-বার্তা বলে এক সময় একাডেমির জিমে গিয়ে ঢুকলেন বিপিএল চ্যাম্পিয়ন রংপুর রাইডার্স অধিনায়ক। সেখানে সচরাচর তিনি যে জিমওয়ার্কটি বেশি করেন, আজও তাই করলেন। উরুর এক্সারসাইজ করলেন। মেশিনে ওজন দেয়ার পর অনেকটা স্প্রিংয়ের মত একটা ধাতবদণ্ডকে পায়ে বার বার সামনে ঠেলা দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক্স ও অনলাইন সাংবাদিকদেরও সময় দিলেন। তাদের সাথেও অনেক বিষয় নিয়েই সব সময়ের মতো কথা বলে গেলেন মাশরাফি।
ঘড়ির কাঁটা দুপুর পৌনে তিনটা অতিক্রম করতে হঠাৎ জিমে দেখা মিললো মোহাম্মদ আশরাফুলের। না না!! জিমওয়ার্ক বা ওয়েট ট্রেনিং করতে নয়- আশরাফুল আসলেন প্রিয় বন্ধু ও দীর্ঘ দিনের সঙ্গী মাশরাফিকে অভিনন্দন জানাতে।
Advertisement
মাশরাফি তখন জিমনেশিয়ামে ভারি সাইকেলের মতো আসনে বসা। আশরাফুল সেখানে প্রবেশ করে কোন দিকে না তাকিয়ে একদম সোজা চলে গেলেন মাশরাফির কাছে। সেখানে গিয়েই এমপি মাশরাফিকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। ভালোবাসার উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন দুই বন্ধু।
মাশরাফিও বন্ধু আশরাফুলকে কাছে টেনে নিলেন। কেন নেবেন না? কত দিনের সম্পর্ক! সেই ২০০০ সালে প্রথমে অনূর্ধ্ব-১৭, এরপর ২০০১ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে এক সাথে খেলে জাতীয় দলে একযুগের বেশি সময় ধরে খেলা দুই বন্ধু তারা।
শুধু বন্ধু বলা বোধকরি কম হয়ে গেল। আশরাফুল আগেও জানিয়েছিলেন আজও বলে উঠলেন, আমরা ১৩ বছর জাতীয় দলে রুমমেট ছিলাম। কখনো রুম আলাদা হলেও মধ্যরাত পর্যন্ত একরুমেই কাটতো। আড্ডা, গালগল্প আর সময় কাটানো সবই হতো একত্রে।
সম্বোধনটাও আন্তরিক। কখনো ‘বন্ধু’, আবার কোন সময় ‘দোস্ত’। সেই কাছের বন্ধু, রুমমেট মাশরাফি এখন জাতীয় সংসদ সদস্য, তাকে ভালবাসায় সিক্ত করতেই বাড়তি আবেগ-উচ্ছ্বাস যেন উপচে পড়ল আশরাফুলের কাছ থেকে।
আলিঙ্গনাবদ্ধ আশরাফুল বলেই উঠলেন, ‘আরে বন্ধু! তুইতো এখন মেম্বার অব পার্লামেন্ট। পুরো বিষয়টা অনেক গর্বের এবং ভালো লাগার। খুব ভাল লাগছে, অনেক ভাল। সংসদ সদস্য হিসেবেও তোর সাফল্য কামনা করছি।’
তারপরও প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট জিমে অবস্থানকালে মাশরাফির হাত ধরেই ছিলেন আবেগতাড়িৎ আশরাফুল। পাশে থাকা সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমরা কিন্তু অনেক পুরনো বন্ধু। সেই যুব দলের হয়ে খেলতে খেলতে বন্ধুত্ব। জাতীয় দলে খেলার সময় আমি আর মাশরাফি টিম হোটেলে রুম শেয়ার করতাম। সময় কাটাতাম একসাথেই। সেই বন্ধু সংসদ সদস্য হয়েছে, তাও বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিতে। এটা অনেক ভালো লাগার। গর্বেরও।’
আশরাফুলের দল চিটাগাং ভাইকিংস প্র্যাকটিস করছিল পাশের মাঠেই। সেই প্র্যাকটিসেই খবর পেয়েছেন তিনি যে, মাশরাফি এসে জিমে ঢুকেছেন। অমনি ছুটে আসলেন তাকে অভিনন্দন জানাতে।
মাঝে আশরাফুল অনৈতিক পথে হাঁটায়, ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন মাশরাফি। কথা-বার্তায়ও মনে হতো আশরাফুলের প্রতি খুব রাগান্বিত। এরপর আশরাফুল ভুল স্বীকার করে জাতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করার পরও মন গলেনি মাশলাফির। মনে মনে আশরাফুলের ওপর ক্ষুব্ধই ছিলেন তিনি।
তবে মনে হয় সময়ের প্রবাহমানতায় সে রাগ, অভিমান আর ক্ষোভ কমে গেছে অনেকটা। তাইতো নিষেধাজ্ঞামুক্ত আশরাফুল যখন গত বছর প্রিমিয়ার লিগের শুরুতে রান পাচ্ছিলেন না, তখন সত্যিকার বন্ধুর মতো পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মাশরাফি। কলাবাগানের হয়ে শুরুতে রান পাওয়া আশরাফুলকে বলেছিলেন, ‘আরে তুই তো মুটিয়ে গেছিস দোস্ত। আগে ওজন কমা। পরিমিত খাবার খা। ভাত ছেড়ে দে। দেখবি ওজন কমে শরীর ঝরঝরে হয়ে যাবে। তখন ভাল খেলতে পারবি।’
প্রিয় বন্ধুর সে পরামর্শ অব্যর্থ টনিকের মত কাজ করেছিল আশরাফুলের জন্য। খাওয়া কমিয়ে ভাত না খেয়ে আশরাফুল ওজন কমিয়ে পাঁচ-পাঁচটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন।
আজও আশরাফুলের আবেগ-উচ্ছ্বাসের জবাবে মাশরাফিও বন্ধুবাৎসল্যেই বললেন, ‘আরে দোস্ত থ্যাঙ্কস! কেমন আছিস? দোয়া করিস, যেন আমার নড়াইলবাসীর জন্য কিছু করতে পারি। এলাকার জন্য কাজ করতে পারি।’
এআরবি/আইএইচএস/এমএস