মতামত

সব দায় কি শুধু শিক্ষকের, অভিভাবকের নয়!

রাত তখন প্রায় সাড়ে ১১টা। হঠাৎ করে মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখি আমার এক আত্মীয় ফোন করেছেন যিনি রাজধানীর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের শিক্ষক।

Advertisement

কোনো দুঃসংবাদ জানাতে ফোন করেছেন কিনা সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোনটা রিসিভ করলাম। হ্যালো বলতে ওপাশ থেকে সালাম বিনিময় করে তিনি অনেকটা অভিমানের সুরেই বললেন, ভাইয়া, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ঘটনাটি আসলে কী? আপনারা মিডিয়াকর্মীরা তো দেখলাম আজ শিক্ষকদের হোয়াইটওয়াশ করছেন। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার টকশোতেও শিক্ষকদের আচরণবিধি নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ওইখানে শিক্ষকদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরার কেউ নেই। একতরফাভাবেই আলোচনা চলছে। অরিত্রির মৃত্যুর দায় কী শুধুই শিক্ষকের, অভিভাবকের কোনো দায় নেই?

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া একজন শিশুছাত্রীর মনোজগত আমলে নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের যেভাবে অপরাধের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে সামাল দেয়ার কথা ছিল তারা সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। শিশু না ভেবে মেয়েটির সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো আচরণ করে অপমান অপদস্ত করেছেন। তার বাবাকে অপমান করা হয়েছে। শিক্ষিকার পায়ে ধরে মাফ চাওয়ার পরও মাফ করা হয়নি। অপমান সইতে না পেরে অরিত্রি আত্মহত্যা করেছে।’

রাজধানীতে যে কটি ভালো স্কুল আছে সেসব স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো পড়াশোনা করানোর জন্য কড়া শাসনের মধ্যে রাখা হয়। নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিতি, ডিসিপ্লিন মেনে চলা ও পরীক্ষায় নকল না করার বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হয়। তিনি বললেন, অরিত্রির বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষার হলে তার মোবাইল ফোনে নকল পাওয়া গেছে। এজন্য শিক্ষক অভিভাবককে ডেকে নকলের বিষয়টি জানিয়ে তাকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট (অভিভাবকের ভাষায়) দেবেন বলে শাসিয়েছেন। মেয়েটি বাড়ি ফিরে ‘অপমান’ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে।

Advertisement

শিক্ষকরা নিশ্চয়ই মেয়েটিকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার জন্য এসব করেননি। নকল ধরে কোনো ব্যবস্থা না নিলে কি অন্য ছাত্রীদের নকলে উৎসাহিত করা হতো না! এখন যদি প্রশ্ন করা হয় মেয়েটির হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিলো কে? এ বয়সী একটি মেয়ের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেয়ার সময় কি মেয়েটি নাবালিকা তা খেয়াল ছিল না।

মেয়েটির আত্মহত্যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে অভিভাবকরাও এর দায় এড়াতে পারেন না। আমার শিক্ষক আত্মীয়টি জানান, আজকাল প্রায়ই জুনিয়র ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখা যায়। কাউন্সিলিংয়ের অংশ হিসেবে আলাপকালে জানতে পারি, বাবা-মায়ের বনিবনা নেই। পড়াশোনার টেবিলে ডেকে বসানোর সময়ও তাদের হাতে নেই।

এসব কারণে ছোট ছোট শিশুরা মানসিকভাবে হীনম্মন্যতায় ভুগছে। বর্তমানে অনেক শিক্ষকও কোচিং বাণিজ্যে জড়িত। তবে কোচিংব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠার নেপথ্যে অভিভাবকরা অনেকটাই দায়ী। তাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা কার ছেলে বা মেয়ে বেশি নম্বর পাবে। এ সুযোগটিই নেন শিক্ষকরা। কারণ শিক্ষকরা ভিন্ন গ্রহের মানুষ নন। এ সমাজেরই মানুষ।

কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সরকারিভাবে আরও কড়া আইন করা হোক। ঢালাওভাবে শুধু শিক্ষকদের ওপর দায় চাপালে শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষকদের জন্য ১১ দফা আচরণ বিধি রয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো আচরণ বিধি প্রণীত হয়নি। সময় হয়েছে তাদের জন্যও আচরণবিধি তৈরি করার। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় না করে শুধু শিক্ষকদের ওপর দায় চাপালে শিক্ষাব্যবস্থার আরও অবনতি হবে।

Advertisement

লেখক: প্রধান প্রতিবেদক, জাগোনিউজ২৪.কম।

এইচআর/আরআইপি