মতামত

নির্বাচনে ‘নিরপেক্ষ’ সুশীলদের লক্ষ্য কী!

‘নির্বাচন না হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ’ গত ২ ডিসেম্বর রবিবার দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পাতায় দুই কলামজুড়ে বড় অক্ষরে এই হেডিং দেখে চমকে উঠলাম। কথাটি বলেছেন নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।

Advertisement

সেগুনবাগিচার একটি রেস্তোরাঁয় ‘মিডিয়া মিউজিয়াম অব বাংলাদেশ’ কর্তৃক আয়োজিত ‘জাতীয় নির্বাচন : গুজব ও সহিংসতা প্রতিরোধে সম্প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্যক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি উল্লিখিত উক্তি করেন।

প্রসঙ্গত বলতেই হয়, বিএনপির দুই জোট তথা জামায়াতকে নিয়ে ২০ দলীয় জোট এবং ড. কামালকে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে, এমন কথা নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল। প্রার্থীজট, প্রধানমন্ত্রী প্রজেক্ট করতে না পারা প্রভৃতি বেশ কিছু লক্ষণ বিদ্যমান রাজনীতির অবস্থা পর্যবেক্ষণে সুস্পষ্ট। প্রবাদ বলে ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।

গত দশম সংসদ নির্বাচন বয়কট ও আগুন সন্ত্রাসের স্মৃতি এখনো মানুষের মনে জাগরুক রয়েছে। এই দিকটি বিবেচনা করেই বয়কট-লক্ষণ সুস্পষ্ট হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলে যাচ্ছেন, ‘একতরফা নির্বাচন হোক তা আমরা চাই না। প্রতিপক্ষকে আটকে রেখে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চাই না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী চান বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন।’

Advertisement

এই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, ডান ও বাম দুদিকের দুই জোট-বন্ধু নিয়ে বিএনপি যে কোনো কারণ বা অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচন থেকে সরে পড়তে পারে, এই ধরনের একটা উদ্বিগ্ন ভাব নির্বাচনী ডামাঢোলের মধ্যে আছে সত্য। কিন্তু নির্বাচন হবে না এই ধরনের কথা কিন্তু একেবারেই শোনা যায়নি!

আর মানুষও গতবারের অভিজ্ঞতা থেকেই মনে করে মিত্রসহ বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলেও নির্বাচন হবেই। কেননা কে নির্বাচন করবে বা করবে না কিংবা বয়কট করে কি করবে, তা সেই দল বা জোটের নিজস্ব ব্যাপার। আর সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা হলো জাতি ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার ব্যাপার। নির্বাচন না হলে যে অবৈধ শক্তি ক্ষমতা দখল করবে, এটা মানুষ বুঝে এবং চায় না।

তাই সুনির্দিষ্ট তারিখেই যে নির্বাচন হবে এটা মানুষের মনে কেবল দৃঢ় বিশ্বাসই নয়, মানুষের তা দৃঢ়ভাবে চায়ও। কমবেশি ১১ বছর আগে যখন ১/১১-এর পর অবৈধ শাসন দীর্ঘায়িত ও পাকাপোক্ত করা কিংবা নিরপেক্ষ সুশীল প্রতিনিধিদের দিয়ে কিংস পার্টি গঠন করে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার বিষয়টা সামনে আসে, তখন মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল এবং তা বানচাল করেছিল।

তাই এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, নির্বাচন না হয়ে যদি অবৈধ শক্তির ক্ষমতা দখলের পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা করতে নামা হয়, তবে জনগণ তা প্রতিহত করবে। আর অবৈধ শক্তির ক্ষমতা দখল বিদেশিরা যেমন মেনে নিবে না, তেমনি সংবিধানেও সেই পথ ধরলে অবৈধ কুশীলবদের ভাগ্যে কি ঘটবে, তা এখন সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাই ওই পথ কেউ মাড়াবে না বলেই ধারণা করা যায়। জাতীয় ও বিশ্বপরিস্থিতিতে এখন ওই পথের অনুকূল নয়। তাই হিতাহিত জ্ঞান থাকলে কোনো মহল-গোষ্ঠীই ওই পথে পা বাড়াবে বলে মনে হয় না।

Advertisement

প্রশ্ন হলো এই পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল সমাজের অন্যতম শিরোমনি সুজন সম্পাদক ‘নির্বাচন না হলে’ কথাটা বললেন কেন? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপের পর যখন দেশের সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে নেমেছে, রেকর্ড সংখ্যক প্রার্থীর দলীয় মনোনয়ন চাওয়া এবং মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার মধ্য দিয়ে যখন নির্বাচনের মাঠ উৎসবমুখর, তখন এই অলুক্ষণে উক্তি করার হেতু কি?

এই হেডিংয়ের নিউজটি পড়ার পর প্রচণ্ড আগ্রহ ও উদ্বেগ নিয়ে নামি-দামি দুই তিনটা পত্রিকার প্রথম ও শেষ পাতা দেখে নিলাম। কিন্তু কই! কোনো পত্রিকার প্রথম পাতায় এই সংবাদটি নেই। প্রশ্ন হলো ইনকিলাব এই ধরনের সংবাদইবা এত গুরুত্ব দিয়ে ছাপলো কেন?

প্রসঙ্গত, যে গোলটেবিল বৈঠকে সুজন সম্পাদক উল্লিখিত কথাগুলো বলেছেন, তাতে বিষয় ছিল গুজব ও সহিংসতা এবং প্রতিরোধে প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে। এটা কার না জানা যে, রাজনীতি ও সমাজ জীবনে গুজব ও সহিংসতা হচ্ছে যমজ দুই ভাই। আর নির্বাচন যেমন আমাদের জনগণের কাছে উৎসব, ঠিক তেমনি রাস্তায় নেমে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে নামাটাও জনগণের উৎসব। অভিজ্ঞতা আমাদের জাতির রয়েছে যে, এই দুই উৎসবের সময় ওই দুই যমজ অতি তৎপর হয়ে ওঠে। এই বিবেচনায় হঠাৎ-কথিত ‘নির্বাচন না হলে’ কথাটি গুজব কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। উদ্বিগ্ন থাকা অবস্থায়ও বলতে হচ্ছে, যদি তাই হয় তবে গুজব প্রতিরোধের বৈঠকে গুজব উত্থাপনের বিষয়টা আগ্রহোদ্দীপক বৈ কি!

প্রশ্ন হলো উল্লিখিত উক্তিটির কি কোনো ভিত্তি আছে? নাকি আদৌ ফাঁকা বুলি? প্রসঙ্গত বলতেই হয় যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও চেতনা নিয়ে বিভক্ত দুই মেরুর রাজনীতিতে দেশ যখন দুই শিবিরে বিভক্ত, তখন দুই বড় দল বা জোটের সমদূরত্বের নীতি নিয়ে যারা চলতে চান, তাদের কিন্তু টিকে থাকতে হলে ‘কান নিয়ে গেছে চিলে’ ধরনের গুজবের প্রয়োজন।

আমরা জানি এবারে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থিতার মনোনয়নপত্রই কেবল জমা পড়ে নাই, রেকর্ড সংখ্যক বিশেষভাবে বড় বড় নেতাদের মনোনয়নপত্র বাতিলও হয়েছে। বাতিলের পর আপিলের সুযোগ আছে। তা সত্ত্বেও এটা নিয়ে শোরগোল হচ্ছে। শোরগোলকারীদের মধ্যে কিন্তু কেউ কোনো উদাহরণ টেনে বলছেন না, কোন নেতার মনোনয়নপত্র বেআইনিভাবে বাতিল হয়েছে?

নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে ডিগবাজি দেয়া দুই ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী নিয়েই বলি। খবরে প্রকাশ, রেজা কিবরিয়ার ক্ষেত্রে ঋণ একেবারে কম টাকা হলেও তিনি ডিফল্টার। নিঃসন্দেহে ওই ঋণখেলাপির টাকা জমা দিলে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হয়ে যাবেন। কিন্তু বাঘা সিদ্দিকী বড় ঋণ ডিফল্টার। ঋণ নিয়েছেন কিন্তু পুলসহ কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রার্থী হতে পারবেন না জেনেও তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন এবং মেয়েকে প্রার্থী হিসেবে রেখেছেন।

কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে কাজ না করা এবং টাকা ফেরত না দেয়া নিয়ে ঘৃণিত হিসেবে ব্যাপক সমালোচনা করা প্রয়োজন, তখন নেতা হিসেবে ছবি ছাপিয়ে বলা হচ্ছে মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। কোর্টের রায়ে যাদের বাতিল হয়েছে, তাদেরও আছে নির্বাচন কমিশনে আপিল করার সুযোগ। প্রয়োজনে তারা কোর্টেও যেতে পারেন। আসলে গভীরে গিয়ে কারণ খোঁজা নয়, গুজবের বুদ্বুদ্ তুলে তাতে কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে নেতারা যেমন নেতা থাকার কৌশল খোঁজেন, তেমনি নিরপেক্ষ থাকা বা সাজাটা হচ্ছে নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল প্রতিনিধিদের কৌশল। এই কৌশল ছাড়া খবরের হেডিং হওয়া যাবে কীভাবে!

এই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, সুজন সম্পাদকের উক্তিটি যদি খবরে থাকার কারণে হয়ে থাকে, তবে রক্ষা। কিন্তু যদি এর মধ্যে যড়যন্ত্র-চক্রান্ত থাকে তবে সর্বনাশ! গুজব ছড়িয়ে যদি ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকারের উদ্দেশ্য থাকে তবে বলতে হবে তিনি আগুন নিয়ে খেলছেন।

প্রসঙ্গত বলতেই হয় যে, বিগত নবম জাতীয় সংসদের আগে তারা ছিল ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দিনের পক্ষে ‘মাইনাস টু’ ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত কার্যকর করে কিংস পার্টি গঠনের সঙ্গে। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৪ সালে নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল সমাজ ছিল সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের বিপক্ষে এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষে। তাই আগুন সন্ত্রাস নিয়ে তারা প্রতিবাদ করা দূরে থাক, কার্যত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বিএনপি-জামায়াতকে ইন্ধন জুগিয়েছিল।

সেই দিনগুলোতে নির্বাচন আটকাতে আমেরিকান এম্বাসেডরকে নিয়ে সুশীলদের প্রতিনিধিরা কেবল মিটিং-সিটিংই করেননি, দিল্লি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তারা যদি দৃঢ়ভাবে সাংবিধানিক সরকারের পক্ষে অবস্থান নিত এবং ‘এক বছরের বেশি সরকার টিকবে না’, ‘নির্বাচন হয়নি তাই বিদেশিরা সমর্থন দিবে না’ বলে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ইন্ধন না দিত, তবে ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট আবারও আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে পাকিস্তানি মদদে গৃহযুদ্ধের দিকে দেশকে ঠেলে দিতে সাহস পেত না।

তাই রাজনৈতিক অঙ্গনে বলা হয়ে থাকে, ওই সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট কেবল হারেনি; নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীলরাও ‘শেখ হাসিনার রাজনীতির কাছে’ পরাজিত হয়েছে। রাজনীতিতে হার-জিত আছে। কিন্তু তথাকথিত নিরপেক্ষদের এই হারটা ইতিহাসের পাতায় কলঙ্কের কালিমায় লিপিবদ্ধ থাকবে।

সুজন সম্পাদকের উল্লিখিত উক্তিতে শঙ্কার আরো কারণ হলো, আমেরিকান এম্বাসেডরদের পিছনে দৌড়ঝাঁপ করার অভ্যেস তারা এখনো ছাড়েননি। আমেরিকান বিদায়ী এম্বাসেডর দৌড়ঝাঁপে সিদ্ধহস্ত মার্শা বার্নিকাটকে সুজন সম্পাদক বাসায় দাওয়াত দিয়েছিলেন। ঘটেছিল এক অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয় ঘটনা।

এ ক্ষেত্রে বলতেই হয়, কূটনীতিক শিষ্টাচারবর্হিভূত বন্ধুত্ব থাকাটা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও সৌজন্য নিমন্ত্রণ খেতে বাড়ি আসাটার মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত নেই। কিন্তু তাতে বর্তমানের ডিগবাজি দেয়া প্রধান নেতারাও ছিলেন বলে জানা যায়। আমেরিকান এম্বাসেডরকে নিয়ে রাজনীতিক-সুশীলদের ককটেল পার্টিতে ওই নিমন্ত্রণ রূপান্তরিত হয়েছিল।

জনগণের উৎসব নির্বাচন সামনে নিয়ে তাই আজকের জ্বলন্ত প্রশ্ন, সুজন সম্পাদকের উল্লিখিত উক্তির মধ্যে কি কোনো শানেনজুল রয়েছে? মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট ধরনের কিছু? মুখে মিষ্টি-মধুর কথার পশ্চাতেই তো থাকে ধারালো-বিষাক্ত ছুরি। ‘ব্রুটাস তুমিও’ কথাটা সর্বত্র সত্য! বিজয়ের মাস চলছে।

দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৪৭ বছর হয়ে গেল। দেশবাসী অবৈধ বিষাক্ত ধারালো ওই ছুরির প্রতিরূপ বন্দুকের লীলাখেলা তো আর কম দেখেনি। এবারে ওই লীলাখেলার শেষ অঙ্ক দেখার অপেক্ষায় থাকবে দেশবাসী।

লেখক : রাজনীতিক।

এইচআর/জেআইএম