ভোট উৎসবের আগেই এবার রকমারি উৎসব নির্বাচনের মাঠে। কোনো কোনোটি একেবারে আজব। কিছু কিছু হাস্যকরও। নৌকা আর ধানের শীষের একচেটিয়া জিকিরে বৈচিত্র্য। দলের চেয়েও যেন বেড়ে গেছে জোটের সংখ্যা। হাজারে হাজার মনোনয়নপত্র বিক্রি। কাতারে কাতারে মনোনয়নপত্র দাখিল। প্রার্থীদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের হিসাবেও মুখরোচক যতো তথ্য। এর কিছু কিছু তামাশারও নামান্তর। কী বিচিত্র দেশ! রাজনীতি- নির্বাচন সবকিছুই বৈচিত্র্যে ঠাঁসা।
Advertisement
বৈচিত্র্যের ষোলকলা মনোনয়ন বাতিলের পর্বে এসে। এক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশে। তা এবার নির্লজ্জ হাসি-মশকরায় রূপ নিয়েছে। আবার পল্টির ব্যারাম-আরামও এবার সার্কাসের মতো বেশ উপভোগের আইটেম। গায়ে মুজিব কোট, মুখে জয় বাংলা স্লোগান, হাতে ধানের শীষ- অপরূপই বটে। তাদের মন আর নয়ন কোথায় ছিল, এখন কোথায়? মন আর নয়ন যোগ করলে দাঁড়ায় মনোনয়ন। কম্বিনেশনটি চমৎকার। তবে কার মন, কার নয়ন মিলে হয় মনোনয়ন? –সেই প্রশ্নের কিনারা নেই। এর আগে, দেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের দীর্ঘদিনের মতাদর্শের এমন পল্টি খাওয়া একদফা বিনোদন জুগিয়েছে। গেলবার যা ছিল বিনাভোটে এমপি হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে। এবার মশকরা শুরু হয়েছে ভোটের আগেই।
বাছাইতে সারা দেশে ৭৮৬ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। ঋণ খেলাপি, বিল খেলাপি ইত্যাদি অপরাধে বাদ পড়াদের বড় অংশই বিএনপির। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও সিনিয়র অনেক নেতাকে বাছাইতে বাদ দেয়া হয়েছে। সংখ্যায় আশির উপরে। এর বাইরে রয়েছে আদালতে দণ্ডিত হওয়া এবং নানা তথ্যের অঙ্গতির অভিযোগ। এসব অভিযোগে ক্ষমতাসীন দলের কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার খবর নেই। তবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া কিছু প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। বিএনপি মহাসচিবের সই মেলেনি-এমন মনে হওয়ায়ও মনোনয়ন বাতিল হয়েছে।
এ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া উপজেলা, পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বেশিরভাগেরই মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। অনেকে পদত্যাগ করলেও পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়ার চিঠি না থাকায় মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। আইন অনুযায়ী, লাভজনক পদে থেকে নির্বাচন করা যায় না। যদিও স্থানীয় সরকারের পদগুলো লাভজনক কিনা বা সংসদ নির্বাচন করতে হলে আগে পদত্যাগ করতে হবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অথচ সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীদের পদত্যাগ করে প্রার্থী হতে হচ্ছে না।
Advertisement
এবার মনোনয়নেও মন আর নয়ন নিয়ে সার্কাসের তীব্রতা রেকর্ড গড়েছে। তা বিএনপির পক্ষেই বেশি। ২৯৫টি আসনে দলটির ৬৯৬ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। প্রায় সব আসনে বিএনপি কৌশলগত কারণে একাধিক প্রার্থীকে প্রাথমিক মনোনয়ন দিয়েছে। কোনো কোনো আসনে দুই থেকে নয়জন বিকল্প প্রার্থীও দেওয়া হয়। গণমাধ্যমে তাদের নাম প্রকাশ হয়েছে অবলিগ দিয়ে। দেখতে এমসিকিউ পদ্ধতির প্রশ্নের মতো। পরে সময় মতো টিক চিহ্ন দিয়ে একজনকে চূড়ান্ত করার এ কৌশল বাংলাদেশে নির্বাচনের জগতে নতুন সংযোজন।
অযোগ্যরা বাছাইয়ে বাদ পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক। ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে আইন–বিধির প্রয়োগটি নির্মোহ এবং মতলবমুক্ত কি না, সেটাই প্রশ্ন। এর আগে, প্রার্থীদের হলফনামা নিয়ে রকমারি তথ্য মানুষকে বিনোদিত করেছে। নির্বাচনে হলফনামা বাধ্যতামূলক করায় কোন প্রার্থীর কত টাকা, তিনি কী পরিমাণ সম্পদের মালিক-ওই এলাকার মানুষের তার কিছু ঝাপসা তথ্য জানার সুযোগ হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও চাইলে এ হলফনামা নিয়ে সমীক্ষা করতে পারে। কোন ধরনের মানুষকে আমরা জনপ্রতিনিধি বানাচ্ছি। কেউ অপরাধী ছিলেন কি না কিংবা অপরাধের খুব কাছ দিয়ে চলে গিয়েছিলেন কি না, তাঁর টাকা কত বেড়েছে, সম্পদ কতটা বেড়েছে-এসব নিয়ে গবেষণা ও জরিপ হতে পারে। প্রার্থীরা হলফনামায় যা লিখেছেন, তার সত্য-মিথ্যা নিয়ে চমকপ্রদ অনুসন্ধান করা যেতে পারে। নির্বাচন, বিশেষ করে নমিনেশনের সঙ্গে টাকার সম্পর্ক ব্যাপক। তা বলার অপেক্ষা রাখে না। টাকা না থাকার দোষে অনেক যোগ্য প্রার্থীও অনেক ক্ষেত্রে মনোনয়ন পান না-এমন তথ্যও অনেকের জানা।
নির্বাচনী আচরণবিধি নিয়েও এবার তেলেসমাতি কাণ্ড বেশি। বিধিমালার ৮ বিধি অনুযায়ী কোনো প্রকার ট্রাক, বাস কিংবা মোটরসাইকেল নিয়ে কোনোরূপ শোডাউন করা যাবে না এবং মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়ও সকল প্রকার মিছিল বা শোডাউন করা নিষেধ। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে শোডাউন করা হয়েছে, কোথাও কোথাও জোরেশেরে নির্বাচনী প্রচারণামূলক কাজও চলছে। অথচ তা নির্বাচন কমিশনের নয়নে আসেনি। এর দায়, দায়িত্ব শুধু এবং একমাত্র নির্বাচন কমিশনের। প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতার ফয়সালা চূড়ান্ত অথরিটিও তারাই।
Advertisement
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। ভাসা, ভাসাভাবে অনেকেরই জানা, প্রার্থী অপ্রকৃতিস্থ, দেউলিয়া, দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিক হলে সংসদ সদস্য হতে বা থাকতে পারবেন না। যদিও আমাদের সংসদ সদস্যদের কারও কারও বিদেশি নাগরিকত্ব রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁর মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়, তাহলে তিনিও নির্বাচনে অযোগ্য। অতীতে দণ্ড (কনভিকশন) ও সাজা (সেনটেন্স) স্থগিত না হলেও দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আমাদের আদালত সংসদ সদস্য হতে বাধা দেয়নি। যার দুই দৃষ্টান্ত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
আর নির্বাচন কমিশন কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্বাচনে অংশ নিতে দিলে আদালত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি, বরং বিষয়টি নির্বাচন–পরবর্তীকালে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সুরাহাযোগ্য বলে রায় দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও আবদুর রহমান বদির দণ্ডপ্রাপ্তির পর সংসদ সদস্য পদে থেকে যাওয়ার ঘটনা দেশের নাবালকদেরও জানা। এরইমধ্যে গত ২৮ নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল ইসলাম আলমের সমন্বয়ে গঠিত একটি ডিভিশন বেঞ্চ ডা. জাহিদসহ বিএনপির পাঁচ নেতার দুর্নীতির অভিযোগে প্রাপ্ত দণ্ড স্থগিত করার আবেদন খারিজ করার আদেশ দেন। এর ভিত্তি ধরে দাবি করা হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়া এবং আরও অনেকে আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য। তবে ভিন্নমতও রয়েছে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ [ধারা ১২] অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ বা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগের কোনে চাকরি থেকে পদত্যাগ বা অবসর গ্রহণকারী ওই পদত্যাগ বা অবসর গ্রহণের পর তিন বছর অতিবাহিত না হলে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। সরকার বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এমন অযোগ্যতা প্রযোজ্য [ধারা ১২]। তাই সরকারি প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
এ বিষয়ের দিকেও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মন-নয়ন যাচ্ছে কি-না ভাবনমুনায় স্পষ্ট নয়। এ ছাড়া নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের সংজ্ঞা আমাদের আইনে নেই। তবে এ ব্যাপারে উচ্চ আদালত তিনটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যথা: মানুষ এর দ্বারা ‘শকড’ বা মর্মাহত হয়েছে কি না; যে কর্মের (যেমন অর্থ আত্মসাৎ) জন্য দণ্ডিত, সে অপরাধ (আত্মসাৎ) করার উদ্দেশ্যেই কর্মটি করা হয়েছে কি না; এবং সমাজ দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নীতিবিবর্জিত বলে মনে করে কি না এবং হেয় চোখে দেখে কি না? অর্থাৎ মন ও নয়নের প্রশ্ন এখানেও।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমকেএইচ