বোবা হয়ে থাকা, মেরুদণ্ড সোজা না করা, বমি লাগলেও অবিরাম হজমের গুণ এখন অনেকেরই আয়ত্বে। গুণটির বিস্তার অনেকদিন থেকে। এর আগে-পিছে কারণ বহুবিধ। প্রধান কারণ নিরাপদ ও ঝামেলামুক্ত থাকা। এ উপায়ের নগদ সুফল মিলছে। আবার বুমেরাংও হচ্ছে। বোবা হয়ে ঝিম মেরে থাকার পরও উল্টো আপদ-বিপদে পড়তে হচ্ছে। এ রকম বাস্তবতার মধ্যে কেন নির্বাচন কমিশনের জরুরি হয়ে পড়লো বোবা হয়ে থাকার তাগিদ দেওয়া? নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মূর্তির মতো থিতু হয়ে থাকার ছবক দেওয়া? অন্তহীন প্রশ্ন এ নিয়ে।
Advertisement
নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ কি ফান করে বলেছিলেন কথাটা? নিজ থেকে বলেছেন? না-কি কেউ তাকে দিয়ে বলিয়ে ছেড়েছে? তিনি কিন্তু বেশ স্মার্টলি দিয়েছেন ছবকটা। মূর্তির মতো বা মেরুদণ্ডহীনভাবে নয়। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তে ২০১৪ সালে বেশ নির্ভারই ছিল নির্বাচন কমিশন।
এবারও বিষয়টা তেমন আলোচিত ছিল না। পর্যবেক্ষণের ঝামেলা এবারও থাকবে না বলে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল। ছিল প্রচারণাও। কিন্তু রাজনীতির নতুন মেরুকরণে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় এ পরিবর্তন। নির্বাচন পর্যবেক্ষণেও আগ্রহ দেখায় দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। ততক্ষণে নির্বাচন কমিশন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নীতিমালায় কিছু ধারা যোগ করেছে।
যথানিয়মে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আগ্রহী বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আগে আবেদন করতে হবে। আবেদন যাচাই করে অনাপত্তির জন্য ইসি তা পাঠাবে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, ভোটকেন্দ্র থেকে সরাসরি সম্প্রচার অথবা ফেসবুক, টুইটার বা অন্য যেকোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা গোপনে বুথে যেতে পারবেন না। সব সময় ইসির সরবরাহ করা পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে হবে। মেনে চলতে হবে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার আইনগত নির্দেশনা। ভোট গণনার সময় একটি পর্যবেক্ষক দল থেকে একজনের বেশি উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
Advertisement
পর্যবেক্ষণের পুরো বিষয়টা সাংবাদিকদের কাছে অল্পকথায় খোলাসা করেছেন নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দিন। সোজাসিধা তিনি বলেছেন, পর্যবেক্ষকদের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলেছেন, ব্রিটিশ রয়াল আর্মির কথা। যারা মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। নির্বাচনের সময় বিদেশি পর্যবেক্ষকদেরও তা-ই করতে হবে। তারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না। মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। তাহলে তারা পারবেনটা কী? পারবেন নির্বাচনের পর একটি প্রতিবেদন জমা দিতে।
বিশ্বের দেশে দেশে বিখ্যাত অনেক ব্যক্তির মূর্তি রয়েছে। জীবদ্দশায় তারা মূর্তির মতো চুপ করে ছিলেন না বলেই সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। এর চিহ্ন হিসেবেই তারা এখনো মূর্তিমান। তাহলে জীবিত মানুষ কেন মূর্তি হবে? কেন এমন ছবক এলো নির্বাচন কমিশন থেকে? তাদের ভয় বা সমস্যাটা কোথায়? একটি স্বচ্ছ নির্বাচন দিতে কি কমিশন প্রস্তুত নয়? তারা কি কিছু লুকাতে চায়?
কমিশন কি চায় না পর্যবেক্ষকেরা পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়া তলিয়ে দেখুক? তা-কি জনমনে নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে বিদ্যমান আস্থাহীনতাকে আরো তাজা করে দিল না? ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা, দখল ঘটতে দেখেও পর্যবেক্ষকদের নির্লিপ্ত থাকতে হবে? বিষয়টি এরকম ছাত্ররা পরীক্ষায় নকল করবে আর শিক্ষক মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকবেন? পরীক্ষার পর প্রধান শিক্ষকের কাছে একটি প্রতিবেদন দেবেন। কিন্তু বিদেশি পর্যবেক্ষকরা তা করবেন? মূর্তি হয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকবেন?
করে নাকো ফোঁস ফাঁস, মারে নাকো ঢুঁশঢাঁশ, নেই কোন উৎপাত, খায় শুধু দুধ ভাত- সুকুমার রায়ের ছড়ার মতো ছাঁচে কি ফেলা যাবে পর্যবেক্ষকদের? এমনতর প্রশ্নের সঙ্গে রীতিমতো রসিকতাও চলছে। অনেকে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করছেন। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত নির্বাচন পর্যবেক্ষকের ভূমিকার সাথে মিস্টার বিনের একটি কমেডির সাথেও হুবহু মানানসই। তাতে ব্রিটেনের লাল পোশাক পরা পুলিশ কাঁধে অস্ত্র নিয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।
Advertisement
মিস্টার বিন তার সামনে গিয়ে অনেক কসরত করেন। কিন্তু তাকে নাড়াতে পারেননি। এমনকি ঘুষি মারার ভঙ্গিমা করেও না। রস-মশকরায় বলাবলি হচ্ছে, বিকল্প হিসেবে ব্রিটিশ রয়াল আর্মি থেকে পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে। এতে পর্যবেক্ষক এবং মূর্তি দুটোই একসাথে পাওয়া যাবে।
পর্যবেক্ষকদের নিরপেক্ষ থাকতে বলা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। যৌক্তিকও। তবে নির্বাচন কমিশন এবার যেভাবে নিরপেক্ষ থাকার নছিহত ও উপমা দিচ্ছে তাতে প্রশ্ন, সংশয় জাগা স্বাভাবিক। পর্যবেক্ষকদের হাত, পা, কান, চোখ এভাবে খড়গে আটকে দেয়া পর্যবেক্ষণকে নিরুৎসাহিত করারই নামান্তর। অথচ এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নানা কারণেই জরুরি।
বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ধারণা ও ঘটনা বেশি দিনের নয়। ১৯৯১-এর নির্বাচনেও পর্যবেক্ষণের কথা আলোচনায় এলেও কার্যকর হয়নি। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণও খুব বেশি দিনের কথা নয়। এ দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ শুরু গত শতাব্দীর শেষ দশকে। ১৯৯৫-এর জানুয়ারিতে ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স-ফেমার মাধ্যমে। পরে আরো বহু পর্যবেক্ষণ সংগঠনের জন্ম। তাদের কোনো কোনোটির নির্বাচনের সময় ওয়াচ ডগের মতো ভূমিকা সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ আবেদন তৈরি করেছে।
আর কিছু কিছুর বিরুদ্ধে রয়েছে দলবাজির অভিযোগ। পর্যবেক্ষণের নামে তাদের কারো কারো দলীয় নেতা-কর্মীর চেয়েও কদাকার ভূমিকা মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। তবে, বিদেশি পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর ভূমিকা প্রশংসিত বিভিন্ন মহলে। এর আগে সাধারণত বিদেশি কূটনীতিকরা পর্যবেক্ষণ করতেন। পরে পর্যবেক্ষণের সারসংক্ষেপ ও নিজস্ব মূল্যায়ন তারা নিজ দেশের সরকারগুলোকে জানিয়ে দিতেন। গণমাধ্যমগুলো বিভিন্ন সোর্সে তা সংগ্রহ করে অংশবিশেষ প্রকাশ করতো। সেটারও ছিল ব্যাপক কদর। সচেতন ও উৎসুকমহল অপেক্ষা করতো সেটি জানার।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/পিআর