মতামত

গুজব প্রতিরোধ ও স্কাইপতর্ক

 

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকারে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন থেকে ভিডিও কলে যুক্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে স্কাইপ বন্ধ রাখার খবর আসে গণমাধ্যমে। একজন দণ্ডিত অপরাধী হিসেবে তিনি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন কি না, আওয়ামী লীগের তরফে সেই প্রশ্ন তোলা হয়। যদিও নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দেয় যে, তারেক রহমানের এই ভিডিও কলে অংশ নেয়া নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে না। পরে স্কাইপ চালু হয় এবং তারেক রহমানও যথারীতি ভিডিও কলে যুক্ত হন।

Advertisement

এরকম বাস্তবতায় আগামী ২৬ নভেম্বর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে একটি বিশেষ বৈঠক ডেকেছে নির্বাচন কমিশন, যেখানে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব বা প্রোপাগান্ডা প্রতিরোধের কৌশল নিয়ে আলোচনা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। বৈঠকে বিটিআরসি, মোবাইল ফোন কোম্পানি, প্রোপাগান্ডা বা গুজববিরোধী কাজে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারাও অংশ নেবেন। এ বিষয়ে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে গুজব ছাড়ানোর বিষয়ে মনিটরিংয়ের জন্য ইসির একটি টিম থাকবে। তবে নির্বাচনের দিন ফেসবুক বন্ধ রাখার পরিকল্পনা আছে কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি জানান, এ ধরনের পরিকল্পনা তাদের নেই।

এর আগে গত ৪ নভেম্বর ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যবেক্ষণ’ নামে একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ১২৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন করবে সরকার। পুলিশ সদর দপ্তরের অধীনে এই প্রকল্পের মনিটরিং করবে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

বাস্তবতা হলো, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, বিশেষ করে সস্তায় স্মার্ট ফোন এবং ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার পরে এই খাতের সবচেয়ে বড় আপদের নাম গুজব, বিভ্রান্তি, চরিত্রহনন, ব্যক্তিগত আক্রমণ। কারো হাতে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট সংযোগ এবং একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকার অর্থই হলো, তিনি একটি অ্যাটম বোমা সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন। যাকে তার পছন্দ নয়, তার বিরুদ্ধে একগাদা কথাবার্তা লিখে ফেসবুকে প্রকাশ করে দেয়ার মাধ্যমে সামাজিকভাবে তাকে হেয় করার পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে এক ঘণ্টাও সময় লাগে না। এই অপরাধের আইনি প্রতিকার পেতে পেতে যার চরিত্র হনন বা যাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হলো, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হতে হতে হাজার হাজার কিংবা লাখ লাখ মানুষের কাছে আক্রান্ত ব্যক্তির সম্পর্কে একটা বার্তা (সেটি সঠিক কিংবা ভুল) চলে যায়। সমস্যা হলো, তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশের সাথে সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক মান ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। আমরা হাতে ছুরি নিয়ে ঘুরছি ঠিক, কিন্তু ছুরিটা কীভাবে চালাতে হয়, সেই জ্ঞানের থেকে ঢের দূরে রয়েছি।

Advertisement

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যবেক্ষণ নামে এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সরকারের তরফে বলা হয়েছে, গুজব, বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট মনিটর করার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সত্য ঘটনা জনগণের সামনে তুলে ধরে বিভ্রান্তি দূর করা। পাশাপাশি যেসব পেজ ও আইডি থেকে বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার চালানো হয়, সেগুলোর ব্যাপারে রিপোর্ট করা এবং সেগুলো বন্ধের ব্যবস্থা করা। প্রকল্পটি চলতি নভেম্বর থেকে আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের আগের মাস থেকে নির্বাচনের পরেও অন্তত চার মাস এই প্রকল্প চলবে। প্রকল্পের এই টাইমফ্রেম বা বাস্তবায়নের সময়সীমাই বলে দিচ্ছে যে, এটি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের একটি বিশেষ প্রকল্প।

প্রশ্ন হলো এরকম একটি প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিলো? সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালীন একটি গুজবকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল তাতে একটি অরাজনৈতিক এবং জনদাবিতে গড়ে ওঠা পুরো আন্দোলনটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং সেই ঘটনার ভুক্তভোগী অনেকে এখনও কারাগারে। যদিও ওই আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় নাকি আন্দোলনটি নস্যাতের জন্য আওয়ামী লীগ অফিসে খুন ও ধর্ষণের গুজব ছড়ানো হয়েছিল, তা এখনও প্রমাণিত নয়।

গুজবটি যারাই ছড়াক না কেন, একটি শান্তিপূর্ণ এবং দেশের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকা আন্দোলনটি যে এর দ্বারা ভয়াবহরকমের ক্ষতিগ্রস্ত এবং নস্যাৎ হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। বস্তুত এই ঘটনার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুকে গুজব প্রতিরোধের বিষয়টি আলোচনায় আসে। কিন্তু গুজব প্রতিরোধের কথা বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী ধরনের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করা হবে এবং এর রাজনৈতিক স্বার্থ ও তাৎপর্য কী- সেটিও ভাবা দরকার।

পাঠকের ভুলে যাওয়ার কথা নয়, ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যমই অনির্দিষ্টকালের জন্য সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের রিভিউ আবেদনের রায় ঘোষণার পর এসব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধের নির্দেশনা জারি করা হয়। এসব মাধ্যম ব্যবহার করে যাতে কোনো ধরনের উসকানি দিয়ে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি না করা যায়, সে জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের তরফে তখন জানানো হয়েছিল।

Advertisement

এর আগে ওই বছরের জানুয়ারি মাসেও বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় ‘নিরাপত্তার’ কারণ দেখিয়ে ভাইবার, ট্যাংগো, হোয়াটসঅ্যাপ, মাইপিপল ও লাইন নামের পাঁচটি অ্যাপসের সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এসব অ্যাপস ব্যবহার করতেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে কারফিউয়ের মধ্যে মোবাইল ফোন সেবা সাময়িক বন্ধ থাকলেও ইন্টারনেট চালু ছিল।

সেই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি স্কাইপ বন্ধ করা হলেও পরবর্তীতে চালু করা হয়। কারণ ভিডিও কলে যুক্ত হওয়ার জন্য স্কাইপ ছাড়া আরও অনেক মাধ্যম আছে। বিটিআরসি নিশ্চয়ই সবগুলো বন্ধ করে সমালোচনার মুখে পড়তে চাইবে না। তাছাড়া নির্বাচন কমিশন যখন বলেছে যে, তারেক রহমানের এই ভিডিও কলে যুক্ত হওয়া নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন নয়, তখন বিটিআরসির পক্ষে স্কাইপ বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে সরকারের সবকিছুই নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে আসে। সরকার যেকোনো কাজ নির্বাচন কমিশনের পরামর্শ নিয়ে করবে- এটিই নিয়ম। সব ক্ষেত্রে এই নিয়ম কতটুকু প্রতিপালিত হয় বা হয়েছে কিংবা হবে, সেটি অন্য তর্ক।

তবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার সীমিত, বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়েই যুক্তি দিয়েছেন। বিশেষ করে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যাতে কেউ এই মাধ্যম ব্যবহার করে কোনো ধরনের অপতৎপরতা চালাতে না পারে, সেজন্য এই নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে- এরকম গুজবে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং বেশ কয়েকজনের প্রাণও যায়। ফলে সরকার যখন এসব ঘটনার উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের কথা বলে, সেখানে খুব বেশি পাল্টা যুক্তি দেয়ার সুযোগ থাকে না।

কিন্তু কিছু লোকের অপতৎপরতা বন্ধ করতে গিয়ে বাকি সবাইকে সেবাবঞ্চিত রাখা এবং আতঙ্কের ভেতরে রাখা কতটা যৌক্তিক- সে প্রশ্নও আছে। বলা হয়, প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ মোকাবিলা ও দমন প্রযুক্তি দিয়েই করা উচিত। মাথা ব্যথার জন্য প্যারাসিটামলই উপযোগী। মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়। সেইসাথে সাইবার অপরাধ দমনে জাতীয় টেলিকম মনিটরিং সেন্টারকে (এনটিএমসি) প্রযুক্তিগতভাবে আরো শক্তিশালী করার উপরেও জোর দেয়া হয়। কেননা নাশকতা ঠেকানোর নামে কয়েকটি অ্যাপস বন্ধ করলে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা হলেও প্রযুক্তির দুনিয়ায় কোনো না কোনোভাবে সেটা ব্যবহারের সুযোগ থেকে যায়। বিশেষ করে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা নিজেদের সুবিধামতো বিভিন্ন অ্যাপস তৈরি করে নেয় এবং সেসবের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে।

উত্তর কোরিয়া, ইরান, চীন, কিউবা, মিসর, সিরিয়া, মৌরিতাস, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম সরকার বিভিন্ন সময়ে তাদের দেশে ফেসবুক বন্ধ করেছে। আবার পরে চালুও হয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া ও ইরানে এখনো ফেসবুক নিষিদ্ধ। চীন সরকার ফেসবুক নিষিদ্ধের বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করলেও বলে যে, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হবে। কিন্তু আমরা দেখেছি প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা হলেও তাকে কেন্দ্র করে সে দেশের সরকার কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেট বন্ধ করেনি। কারণ তারা জানে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ কোনো সমাধান নয়, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দিলে প্রতিক্রিয়াশীলদের, অর্থাৎ যাদের ভয়ে এসব মাধ্যম বন্ধ করা হয়েছে, তাদের কাছে নৈতিক পরাজয় ঘটে। অর্থাৎ নাশকতা ঠেকানোর নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার অর্থ হলো নাশকতাকারী বা গুজব সৃষ্টিকারীদের কাছে হার মানা। বরং এই অপশক্তিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেই মোকাবিলা করা প্রয়োজন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণ প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, গুজব, বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট মনিটরিং করার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সত্য ঘটনা জনগণের সামনে তুলে ধরে বিভ্রান্তি দূর করা। প্রশ্ন হলো বিভ্রান্তিমূলক পোস্টের সংজ্ঞা কী? কোন পোস্টকে কে বিভ্রান্তিমূলক বলে ব্যাখ্যা দেবেন? ভোটের সময় প্রার্থীরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করতে নানারকম কৌশল নেয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষমতাবান কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকেরা সত্যমিথ্যা যাই লিখুক, সেটিকে যদি গুজব বা বিভ্রান্তিমূলক বলে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়, তখন সেখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে কি না?

মনে রাখা দরকার, এসব নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যই ছিল বিশেষ কাউকে সুবিধা দেয়া। নির্বাচনে যদি কোনো বিশেষ দল বা ব্যক্তি অন্যের চেয়ে বেশি সুবিধা পায় এবং সেখানে যদি খোদ রাষ্ট্রই পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাহলে সেই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ থাকে না। অতএব জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য যদি হয় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সহায়তা করা, তাহলে একে স্বাগত জানানোই উচিত। কিন্তু এর উদ্দেশ্য যদি হয় ভিন্নতর কিছু, অর্থাৎ বিশেষ কাউকে সুবিধা দেয়া এবং অন্যদের উপর নজরদারি, সেক্ষেত্রে জনগণের টাকায় এরকম একটি প্রকল্পের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস