মতামত

মন্দের ভালোর রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ

বিদেশি কূটনীতিকদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ করে নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে ব্রিফ করেছে বিএনপি। কোন পরিস্থিতিতে, কেন বিএনপি নির্বাচনে গেছে, সেটা দলের নেতারা তুলে ধরেছেন কূটনীতিকদের কাছে। তাদের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী আটক থাকা এবং চলমান ধরপাকড়ের কথাও জানানো হয়েছে।

Advertisement

বিএনপি বা কোনো দল নির্বাচনে অংশ নেবে- এটা কেন খুব বড় খবর? বরং অংশ না নেওয়ার ঘটনার নিউজভ্যালু বেশি হতে পারে। কিন্তু বিএনপি নামক দলটি নির্বাচনে শরীক হচ্ছে-এটাই গুরুত্বপূর্ণ খবর গণমাধ্যমে। মানুষের মধ্যেও আলোচিত। রাজনৈতিক বাস্তবতাটা এ জায়গায়ই এসে ঠেকেছে। গণমাধ্যম আর গণমানুষ বাস্তবতারই শিকার এবং প্রতিচ্ছবি।

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রাচীন দল। এ দেশের ইতিহাসের অংশ। অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাসের জন্মদাতাও। বিশেষ করে ভোটাধিকারের আন্দোলন এ দলটির অন্যতম ঐতিহ্য। আবার মানুষকে ভোটাধিকার হারা করার কুদৃষ্টান্তও স্থাপন হয়েছে এ দলটির হাত দিয়ে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ডেটলাইনে আওয়ামী লীগের গায়ে লেপ্টে গেছে এ কলঙ্ক। বাস্তবতা কতো নির্মম-নিষ্ঠুর, সাংঘর্ষিক! এরপরও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে এককভাবে শক্তিমান দল। শুধু বিএনপি কেন, বাদবাকি সবদল মিলেও শক্তি-বুদ্ধিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পেরে ওঠে না। মোকাবেলা তো আরো পরের বিষয়। এমন সামর্থ্যের পরও আওয়ামী লীগ নানা শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের জন্য পার্টনারশিপ ওপেন করে দিয়েছে। হেফাজত, স্বৈরাচারসহ দলের আদর্শবিরোধীদের সঙ্গে দলটির এখন নতুন এক মেলবন্ধন।

আওয়ামী লীগের এই ইনফিনিটির বিপরীতে ডান-বাম রসায়নে এর বিপরীত ঘরানায় গড়ে ওঠা দল বিএনপি। সাম্প্রতিক সময়ে লেটেস্ট ভারসন এসেছে দলটিতে। রাজনৈতিক এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে বিএনপির সঙ্গে ড. কামাল হোসেন, আসম রব, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো আওয়ামী প্রোডাক্টদের বিশেষ সন্ধি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে তারা আওয়ামী লীগের কাছে রাজাকার, ষড়যন্ত্রকারী ইত্যাদি। বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান হিসেবে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বশ্যতা মেনেছে। আবার ২০ দলীয় জোটের মুরুব্বি দল হয়েও ঝাণ্ডা তুলে দিয়েছে এলডিপি সভাপতি কর্নেল অব. অলি আহমদের ওপর।

Advertisement

বিএনপি জামায়াতমুক্ত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সদস্য। আবার জামায়াতযুক্ত ২০ দলীয় জোটেরও সদস্য। ঐক্যফ্রন্টের শরীক ও আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। কয়েকটা ফাঁক তারা রেখেছে। এরইমধ্যে মানুষের বেশ আগ্রহও তাদের প্রতি। প্রকাশ্যেই দলটির কৌশলের এ অভিনবত্ব। রাজনীতির ইতিহাসে নতুনত্ব। আবার বিএনপির স্পেশাল প্রোডাক্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, মেজর অব. মান্নানরা আওয়ামী লীগের খাসকামরায় ঢুকে পড়েছেন।

পাল্টাপাল্টি দাও মারার এ প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের রাজনীতিকে কোন পরিণতি বা সন্ধিক্ষণের দিকে নিচ্ছে, তা এখনো বলার সময় আসেনি। তবে, ভাব-নমুনা অনেক কিছুর ইঙ্গিতই দিচ্ছে। গণতন্ত্র, উন্নয়ন, ভোটাধিকার, মর্যাদার গ্যারান্টি দিয়ে ক্যানভাস করা ব্যক্তিত্বদের মত-মতলব একই।

পথের ব্যবধানও কম। রাজনীতি অবশ্যই কৌশলের খেলা। তাই বলে সন্ধিক্ষণকে আলিঙ্গন করে? মানুষকে ধোকাবাজি-ঠকবাজিতে ফেলে? নীতি-আদর্শের একটু-আধটু অবশিষ্ট থাকতেও মানা? সিম্পলের মধ্যে এমন গর্জিয়াস আয়োজন মানুষ একটুও বোঝে না? নিজের রাজনৈতিক ভূমিকা পরিষ্কার করতে না পারা এই চক্রবাজি থেকে মানুষের বের হওয়ার পথ অদেখা। যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে রাজনীতি বা নির্বাচন থেকে বিরত থাকার কাউকে কি দেখছে তারা? তবুও অন্তত প্রতিকী প্রতিবাদীর খোঁজ মিলতো।

মাস কয়েক আগেও রাজনীতির এমন সন্ধিক্ষণের কথা ভাবনায় আসেনি রাজনৈতিকজ্ঞানে পাকা-পোক্ত অনেকেরও। সরকারের দক্ষ-সামর্থ্য হাতের নানা চমক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তি, বেগম খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড, তারেক রহমানের যাবজ্জীবন, মা-ছেলে উভয়ের দলীয় নেতৃত্বও আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করার মতো কঠোর অবস্থার মধ্যে বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার শক্তি পাবে তা ছিল ভাবনাতীত। নানা গুজব- গুঞ্জন, রটনা-ঘটনার পরম্পরায় এখন সেটাই বাস্তবতা। সব কি সিম্পল-সিম্পলি?

Advertisement

সরকারের কৌশল এবং নানা আয়োজনে বিএনপি হেরে গেছে কবেই। অবশিষ্টের আর অবশিষ্টও না থাকার এ অবস্থার মধ্যেই ঐক্যফ্রন্টের মোড়কে সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস হয়ে উঠছে বিএনপি। ক্ষমতাসীন দল থেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হলেও ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপিকে মোকাবেলা একদম সহজ মনে করা হচ্ছে না। সেটা সরকারি দলের মহলের নানা উক্তি ও তৎপরতায় স্পষ্ট। ক্ষমতায় থাকার সুবাদে নির্বাচনী আইন মোতাবেক প্রার্থী বাছাইসহ যাবতীয় কর্মযজ্ঞ তারা চালাচ্ছে রিলাক্সেই। কিন্তু ভেতরে রিলাক্স বাইরে ভাবভঙ্গিতে যেমন দেখানো হয় আসলে তেমন নয়।

মনোনয়ন ফরম বিতরণ নিয়ে রাজধানীতে সহিংসতায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের যুদ্ধে দুটি প্রাণ ঝরলেও একে মামুলি রূপ দেয়া সম্ভব হয়েছে ক্ষমতার বদৌলতেই। অবস্থা বুঝে নিহতদের পরিবারও এরইমধ্যে চুপসে গেছে। দৃশ্যত. আয়ত্বে চলে এসেছে। মোটকথা কোথাও তেমন বাধা বা ছেদ পড়ছে না। এর বিপরীতে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানো পর্বত জয়ের মতো কঠিন কাজ। বিগত নানা ঘটনার রেশ টানতে হচ্ছে তাদের। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের পর বিএনপি রাজপথে রাজনৈতিক বিরোধের ফয়সালার চেষ্টায় তারা সফল হয়নি। তারওপর রয়েছে ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে আগুন ও বোমাবাজির বদনাম।

এতো কিছুর পরও দলটির ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা কম মিরাকল নয়। বিএনপির ওপর সরকারের দমন-পীড়নে মানুষ বিরক্ত। তারা আবার বিরোধীদলের জ্বালাও-পোড়াও কামনা করে না। দেশে রাজপথে রাজনৈতিক কোনো মতবিরোধের কিনারা হবে না, সেটাও আপাতত প্রায় নিশ্চিত। এটা বড় দুই দল বা সব রাজনৈতিক পক্ষের জন্যই প্রযোজ্য। বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সরকারের একটি বড় অর্জনও এসেছে। সেটা রাজনৈতিক বৈধতা। যা সংবিধান এত দিন তাদের দিতে পারেনি। আবার এ বৈধতা একেবারে একতরফা বা চিরস্থায়ী- এমনটি মনে করারও কারণ নেই। এতো কিছুর পরও আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু ঘটনা এরইমধ্যে ঘটেছে। সংলাপ এবং নির্বাচনী আয়োজনের সুবাদে রাজনীতিতে গালমন্দ কমেছে। বিভিন্নপক্ষের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বেড়েছে। এটাও মন্দের ভালো।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/আরআইপি