দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মোট লেনদেনের ৬০ শতাংশ রয়েছে মাত্র চারটি খাতের দখলে। তবে আশ্চর্যের বিষয় এ চার খাতের তালিকায় নেই পুঁজিবাজারের প্রাণ হিসেবে পরিচিত ব্যাংক খাত। গত দুই মাস ধরে এ অবস্থা বিরাজ করছে। অক্টোবর শেষে লেনদেন নিয়ে ডিএসইর তৈরি করা প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
Advertisement
ডিএসইর খাত-ভিত্তিক কোম্পানির তালিকা থেকে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ২২টি খাতে বিভক্ত। এর মধ্যে লেনদেন হয় ২০টি খাতের। গত দুই মাস ধরে লেনদেনে প্রভাব বিস্তার করা চারটি খাতের মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, বস্ত্র, প্রকৌশল ও ওষুধ খাত। এর মধ্যে অক্টোবর মাসে লেনদেনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দাপট দেখায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে বেশি দাপট ছিল প্রকৌশল খাতের।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর জুড়ে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ১২ হাজার ৭৩৭ কোটি পাঁচ লাখ টাকার। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ৫৪৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। আগের মাস সেপ্টেম্বরে এ খাতের শেয়ার লেনদেন হয় দুই হাজার ৫৩১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ১৭ দশমিক ১০ শতাংশ।
এর পরের স্থানেই রয়েছে বস্ত্র খাত। অক্টোবরে এ খাতের বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ২১১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে এ খাতের শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২১০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ১৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
Advertisement
এক হাজার ৫৬৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে প্রকৌশল খাত। মাসটিতে মোট লেনদেনের ১২ দশমিক ৩১ শতাংশই ছিল এ খাতের দখলে। সেপ্টেম্বরে প্রকৌশল খাতের শেয়ার লেনদেন হয় দুই হাজার ৭৭৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। মাসটিতে প্রকৌশল খাত লেনদেনের শীর্ষে ছিল।
লেনদেনের প্রভাব বিস্তার করা আর একটি খাত ওষুধ। অক্টোবরে এ খাতের শেয়ার লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৪১২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ১১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে এ খাতের শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৬২১ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা মাসটির মোট লেনদেনের ১০ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
এদিকে ২০১০ সালে পুঁজিবাজারের উত্থানে বড় ভূমিকা রাখে ব্যাংক খাত। সে সময় পুঁজিবাজারের প্রাণ হিসেবে বিবেচিত হতো এ খাত। ডিএসইতে মোট লেনদেনের প্রায় ৩০ শতাংশ ছিল ব্যাংক কোম্পানিগুলোর শেয়ারের। তবে মহাধসের পর অনেকটা ধারাবাহিকভাবে এ খাতের অবদান কমে যায়। কমতে কমতে ২০১৬ সালে এসে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেঁকে।
এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে গত বছরের শেষার্ধে এবং চলতি বছরের প্রথমার্ধে আবারও একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ব্যাংক। ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট লেনদেনের ২৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ ছিল ব্যাংকের দখলে। তবে গত দুই মাস ধরে লেনদেনে ব্যাংক খাত খুব একটা দাপট দেখাতে পারেনি।
Advertisement
অক্টোবরে বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয়েছে এক হাজার ১৫৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকার, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে এ খাতের শেয়ার লেনদেন হয় ৭৯৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরের নয় মাসের ব্যবসায় তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব এ খাতের শেয়ার লেনদেনের ওপর পড়েছে। সেই সঙ্গে সার্বিক পুঁজিবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের নয় মাসের হিসাবে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে নগদ অর্থ সংকটে পড়েছে ১৩টি ব্যাংক। ১৮টির মুনাফা আগের বছরের তুলনায় কমেছে। সম্পদ কমেছে ১০টির এবং একটি লোকসানের মধ্যে নিমজ্জিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান জোগো নিউজকে বলেন, ব্যাংকের ব্যবসা প্রায় স্থবির হয়ে গেছে। ব্যাংক খাতে সাংঘাতিক তারল্য সংকট চলছে। অনেক ব্যাংক এখন নতুন ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারছে না, নতুন লোন দিচ্ছে না। ব্যাংক খাতের এ অবস্থার কারণে বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। এতে পুঁজিবাজারেও কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থা পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যাংকের যদি ইনকাম কমে যায়, প্রভিশন বেশি করতে হয়, খেলাপি ঋণ বেড়ে যায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তা পুঁজিবাজারে খারাপ প্রভাব ফেলবে। কারণ ব্যাংক পুঁজিবাজারের একটি বিরাট খাত। বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের শেয়ারে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছেন।
ডিএসইর মাস-ভিত্তিক লেনদেনের তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, বস্ত্র, প্রকৌশল, ওষুধ ও ব্যাংক বাদে অক্টোবরের মোট লেনদেনে বাকি খাতগুলোর প্রত্যেকটির এককভাবে অবদান পাঁচ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে চার শতাংশের ঘরে আছে তিনটি, তিন শতাংশের ঘরে একটি, দুই শতাংশের ঘরে দুটি। বাকি নয়টি খাতের এককভাবে অবদান এক শতাংশের ঘরে বা তারও কম।
মোট লেনদেনের চার শতাংশের ঘরে থাকা খাতগুলোর মধ্যে আর্থিক খাতের ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ ও বীমার ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এছাড়া খাদ্যের ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ, আইটির ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং সিমেন্ট খাতের ২ শতাংশ।
এক শতাংশের ঘরে বা তার কম অবদান থাকা খাতগুলোর মধ্যে- সিরামিকের ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ, ভ্রমণের ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ, চামড়ার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, টেলি কমনিকেশনের ১ দশমিক ৪০ শতাংশ, কাগজ ও মুদ্রণের ১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, সেবা ও আবাসনের দশমিক ৬২ শতাংশ, পাটের দশমিক ৩৭ শতাংশ, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ৩২ শতাংশ এবং বন্ডের দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।
এমএএস/এমএআর/পিআর