‘বাবা নির্মল চন্দ্র মন্ডল মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পুলিশের চাকরি করবো শুনেই বলেছিলেন দরকার নেই, এ চাকরিতে দুর্নাম আর বদনামই বেশি। উত্তরে আমি বলেছিলাম, আপনি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। আমাকেও মানুষের সেবা করার সুযোগ দিন। ওয়াদা করছি সততা আর পরিশ্রমকে পুঁজি করেই চাকরি করবো। আমি যতদূর সম্ভব পুলিশের উপরের পদে যাবো, সম্মানের সাথেই যাবো। বাবাকে দেয়া সেই ওয়াদা মনে রেখেই রাস্তায় মানুষের সেবা করছি। কেউ আইন লঙ্ঘন করলে মাথা গরম হয়ে যায়। সহ্য করতে পারি না। অন্যায় ঠেকাতে গিয়ে চাকরি চলে গেলেও দুঃখ নেই। ঢাকায় বাড়িও নেই, প্রচুর টাকাও নেই। চাকরি চলে গেলে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পৈত্রিক নিবাস পিরোজপুরের নাজিরপুরের তারাবুনিয়া গ্রামে চলে যাবো।’সোমবার সকালে এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকারে নিজের সম্পর্কে এভাবেই জাগো নিউজকে বলেন- আলোচিত ট্রাফিক সার্জেন্ট (এএসআই) অপূর্ব কান্তি মন্ডল। সংক্ষিপ্ত আলাপকালে তিনি বলেন, সততার পুরস্কার বুঝি এভাবেই পাওয়া যায়। আপনার (প্রতিবেদক) সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। গতকাল (রোববার) ডিউটিরত অবস্থায় কর্তব্যপরায়ণতা দেখে ‘সচিবের গাড়ির কনস্টেবলও সচিব!’ শিরোনামে যে প্রতিবেদনটি করেছেন সেজন্য আমি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাসহ বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছি।এ জন্য জাগো নিউজ কর্তৃপক্ষের কাছে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও ভুলেননি তিনি। কথাগুলো বলেই যানজট নিয়ন্ত্রণে রাস্তায় ছুটে যান অপূর্ব কান্তি মন্ডল।যে পুলিশের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগের অন্ত নেই সেই পুলিশের একজন সদস্যের দৃঢ়চেতা বক্তব্যের নেপথ্যের কারণ ও কৌতুহলবশত তাঁর অতীত ইতিহাস জানতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন এ প্রতিবেদক।অপূর্ব কান্তি মন্ডল ২০০১ সালের ১৮ জুলাই কনস্টেবল হিসেবে পুলিশের চাকরিতে যোগ দান করেন। অনেকটা নাটকীয়ভাবেই তার চাকরিতে যোগদান। তিনি জানান, গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে ১৯৯৪ সালে এসএসসি পাস করেন। পড়াশুনায় খুব ভালো ছিলেন না। পরীক্ষার ফলাফল ভালো না হওয়ার সোহরাওয়ার্দী কলেজে ভর্তি হন। ১৯৯৬ সালে এইচএসসিতে অকৃতকার্য হন। ১৯৯৭ সালে এইচএসসি পাস করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে (বর্তমানে- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) অনার্সে ভর্তি হন। ২০০১ সালে চাকরিতে প্রবেশের আগ পর্যন্ত এক বন্ধুর সঙ্গে শাড়ির ব্যবসা করতেন। পরবর্তীতে বনিবনা না হওয়ায় ঢাকা ছেড়ে লঞ্চযোগে পিরোজপুর রওনা হন।লঞ্চ তখন চাঁদপুরের ঘাটের কাছাকাছি। একটি পুরোনো জাতীয় দৈনিকে একটি বিজ্ঞপ্তি দেখে চোখ আটকে যায় তার। শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেয়া হবে। জেলার কোটায় পিরোজপুরের নামও রয়েছে। আবেদনের সময় মাত্র ২দিন বাকি। শিক্ষাগত সকল সার্টিফিকেট রয়ে গেছে বন্ধুর বাসায়। বরিশাল চলে গেলে আর দরখাস্ত করা হবে না। চাঁদপুর নেমে বাসযোগে কাকডাকা ভোরে ঢাকায় ফেরত চলে আসেন তিনি। সেখান থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে প্রয়োজনীয় ফটোকপি করে রাতে সুন্দরবন পরিবহনযোগে পিরোজপুর পৌঁছান- এভাবেই বলছিলেন তিনি।তিনি আরো বলেন, পিরোজপুর পৌঁছে বান্ধবীর বাবার মাধ্যমে কাগজপত্র সত্যায়িত করি। বান্ধবীর বাবা যিনি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ছিলেন মূলত তার সততা দেখেই আমি অনুপ্রাণিত হই। আমি দেখেছি তিনি উপ-পরিচালক পদে চাকরি করলেও তার বাড়ি গাড়ি ব্যাংক ব্যালেন্স কিছুই ছিল না, খুবই সাদামাটা জীবনযাপন করতেন তিনি। পরীক্ষায় আমি খুব সহজেই কনস্টেবল পদে নিয়োগ পেয়ে যাই।টানা ১০ বছর চাকরি করার পর ২০১১ সালে এএসআই পদে পদোন্নতি পান অপূর্ব। বাবা স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। তারা দু’জনেই চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। এক ভাই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রী মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে চাকরি করছেন। ছেলে ক্ষেত্রজিৎ মন্ডল এমি ও এনজেল মন্ডল টুকুকে নিয়ে তার সংসার। বাবাকে দেয়া কথা অনুসারে সততার সঙ্গে চাকরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান অপূর্ব।চলে আসার সময় আবারো ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, সততা আর পরিশ্রম আমার পুঁজি, যতদূর সম্ভব পুলিশের বড় পদে যেতে যাই।# সচিবের গাড়ির কনস্টেবলও সচিব!এমইউ/আরএস/এসএইচএস/আরআইপি
Advertisement