খেলাধুলা

সাহস দিচ্ছে ইতিহাস, দরকার দায়িত্বশীল ব্যাটিংও

সর্বশেষ সাত ইনিংসে যে দল দুইশোও করতে পারেনি, চলতি ম্যাচে যাদের প্রথম ইনিংস শেষ হয়েছে মাত্র ১৪৩ রানে- সেই দল রান খরা কাটিয়ে ৩২১ রানের চাপ সামলে ম্যাচ জিতবে, এমন আশাবাদী হওয়া কঠিন। সে অর্থে সাম্প্রতিক ব্যাটিং ব্যর্থতা চিন্তার কারণ। ম্যাচ না জেতার সংশয়ের জন্ম দিয়েছে।

Advertisement

তবে কি বাংলাদেশের কোনো আশাই নেই? ভক্তরা যখন এমন চিন্তায় নিমগ্ন তখনই আলোকবর্তিকা হয়ে দেখা দিয়েছে ইতিহাস। অতীত আশা জাগাচ্ছে। ইতিহাস জানান দিচ্ছে আগে কখনো ২১৫ রানের বেশী জয়ের টার্গেট ছুঁতে না পারলেও চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের তিন তিনবার ৩০০’র বেশী রান করার রেকর্ড আছে ।

বলার অপেক্ষা রাখেনা ঐ তিনবারের একবারও টেস্ট জেতা সম্ভব হয়নি। ম্যাচ বাঁচানো মানে ড্রও হয়নি। প্রতিবারই হেরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড আর ভারতের মত শক্তিশালী দলের বিপক্ষে বুক চিতিয়ে লড়াই করার নজির আছে টাইগারদের।

পরিসংখ্যান সাক্ষী দিচ্ছে, টেস্টে চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ৪১৩। সেটা ১০ বছর আগের ঘটনা। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার শেরে বাংলায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫২১ রানের পাহাড় সমান টার্গেটের পিছু ধেয়ে বাংলাদেশ ৪১৩ রান করে ফেলে বাংলাদেশ।

Advertisement

শ্রীলঙ্কার বোলিং তখন বিশ্বমানের। চামিন্দা ভাস, মুত্থিয়া মুরালিধরন ও রঙ্গনা হেরাথের মত অসামান্য বোলিং প্রতিভায় সাজানো লঙ্কান ধরালো সুঁচের মত বোলিংয়ের বিপক্ষে মোহাম্মদ আশরাফুলের অনবদ্য শতরান (২০৯ মিনিটে ১৯৩ বলে ১৬ বাউন্ডারিতে ১০১), সাকিব আল হাসানের ৯৬ আর মুশফিকুর রহিমের ৬১ রানের তিন তিনটি কার্যকর ইনিংসের ওপর ভড় করে চতুর্থ ইনিংসে ১২৬.২ ওভার ব্যাটিং করে ১০৭ রানে হারলেও ৪০০+ রান করে সাড়া জাগায় বাংলাদেশ।

এরপর চতুর্থ ইনিংসে আরও দুইবার ৩০০+ রান আছে টাইগারদের। প্রথমবার ২০১০ সালের ১২-১৬ মার্চে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ৫১৩ রানের হিমালয় সমান টার্গেটের পিছু নিয়ে ১২৪ ওভারে ৩৩১ রান করে সাকিব আল হাসানের দল। জুনায়েদ সিদ্দিকীর শতক (১০৬) আর মুশফিকুর রহিমের ৯৫ রানের ইনিংসে চতুর্থ ইনিংসে ৩০০ পেড়িয়ে যায় বাংলাদেশ।

ঐ বছরই চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে চতুর্থ ইনিংসে ৩০১ রান করে ১১৪ রানে হার মানে। সামনে লক্ষ্য ছিল ৪১৫ রানের। মুশফিকুর রহিমের শতক (১০৭) আর তামিম ইকবালের হাফ সেঞ্চুরির (৫২) ওপর ভর করে জহির খান, শ্রীশান্ত-ইশান্ত শর্মা আর অমিত মিশ্রর গড়া ভারতের ধারালো বোলিং শক্তির বিপক্ষে শেষ ইনিংসে ৭৫.২ ওভারে ৩০০ পেড়িয়ে যায় বাংলাদেশ।

আগের টার্গেটগুলো ছিল বেশ বড়- ৫২১, ৫১৩ ও ৪১৫। তারচেয়ে এবারের টার্গেট ছোট। তারচেয়ে বড় কথা, জিম্বাবুয়ের বোলিংশক্তি তত সমৃদ্ধ নয়। দুই পেসার কাইল জারভিস, টেন্ডাই চাতারা আর অফস্পিনার সিকান্দার রাজা- যারা কেউই বিশ্বমানের নন।

Advertisement

জারভিস আর চাতারা ভাল জায়গায় বল ফেলতে পারেন। টেস্ট মানেই ব্যাটসম্যানের ধৈর্য্য , টেকনিক আর টেম্পারামেন্টের পরীক্ষা। ঐ দুই জিম্বাবুয়ান সে পরীক্ষায় ফেলতে পারেন। অফস্টাম্প ও তার আশপাশে ভাল জায়গায় বল ফেলতে পারলে ব্যাটসম্যান ভুল করবে- তা ভালই জানা চাতারা ও জারভিসের। তাই তারা ঐ চেইনে বল ফেলার চেষ্টা করান।

সিকান্দার রাজা নামেই স্পিনার। বল ঘোরেনা তেমন। বৈচিত্রও নেই তেমন। বুদ্ধিই সম্বল। ব্যাটসম্যানের মতি-গতি লক্ষ্য করে বল করেন। উইকেটে মাঝে মধ্যে একটু আধটু টার্ন আছে। আজও লিটন দাসের বিপক্ষে লেগবিফোর উইকেটের জোরালো আবেদন ছিল তার। পরে টিভি রিপ্লে নিশ্চিত করেছে বল লেগস্টাম্প মিস করতো।

সাম্প্রতিক সময় যত খারাপই যাক না কেন, টেস্টে ব্যাটিং যত অনুজ্জ্বলই থাকুক না কেন বড় সত্য হলো- লক্ষ্য প্রায় সোয়া তিনশো হলেও প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ের বোলিং কিন্তু কমজোরি।

এমন মাঝারী বোলিংয়ের বিপক্ষে ৩২১ (যার ২৬ হয়েই গেছে, আর দরকার ২৯৫) রান কিন্তু অসম্ভব নয়। তামিম ও সাকিব থাকলে আশা করাই যেত। ঐ দুই চালিকাশক্তি না থাকলেও লিটন, ইমরুল, মুমিনুল, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহরও এমন নির্বিষ বোলিংয়ের বিপক্ষে ভাল খেলার পর্যাপ্ত সামর্থ আছে।

প্রথম ইনিংসে তারা ভুল করেছেন। টেকনিক ও টেম্পারামেন্ট দুই-ই ঘাটতি ছিল। অফস্টাম্পের বাইরের বল তাড়া করা, বলের পিছনে শরীর ও পা না নিয়ে খেলতে গিয়ে বিপদ ডেকে এনেছেন।

অফস্টাম্পের বাইরে অযথা খোঁচাখুঁচি না করা হবে প্রথম কাজ। ওয়ানডে মেজাজে থার্ডম্যান, গালি ও পয়েন্টের আশ পাশ দিয়ে বার বার বল গড়ানোর চেষ্টাও বাদ দিতে হবে।

বলের লাইন-লেন্থ ও ম্যুভমেন্ট বুঝে হয় ছেড়ে দেয়া না হয় ডিফেন্স এবং হাফ ভলি, ওভার পিচড আর শর্ট অফ লেন্থের ডেলিভারির অপেক্ষায় থাকাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। চাতারা, জারভিস আর সিকান্দার রাজারা কেউ আহামরি মানের বোলার নন। তাদের সামর্থও সীমিত। পেসারদের গতি, সুইং ও ম্যুভমেন্ট কম। আর রাজার বলও তেমন ঘোরেনা। কাজেই দেখে খেললে সফল না হবার কারণ নেই।

সবচেয়ে বড় কথা ওপরের দিকে মানে দুই ওপেনার লিটন-ইমরুল আর মুমিনুলের যে কোন একজনের একটি দীর্ঘ ইনিংস এবং দুটি লম্বা পার্টনারশিপ দরকার।

যাদের কথা বলা হলো, তাদের সামর্থ আছে। এখন জায়গামত সে সামর্থের প্রয়োগ ঘটানো খুব জরুরী। লিটন সীমিত ওভারের ফরম্যাটে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। টেস্টে একটি বড় ইনিংস দরকার। ইমরুল অনেক দিন পর ওয়ানডেতে নিজেকে দারুণভাবে ফিরে পেয়েছেন। একটু সচেতন হয়ে একদিক আগলে রাখার দায়িত্বটা কাঁধে নেয়ার চেষ্টা থাকলে বাঁহাতি ইমরুলও লম্বা ইনিংস খেলে ফেলতে পারেন।

মুমিনুলের ব্যাট কথা বলছেনা কিছু দিন। আগের সেই ঔজ্জ্বল্যটা কোথায় হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশের টেস্ট ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তার রেকর্ড সবচেয়ে ভাল। কিন্তু সেই মুমিনুল গত কয়েকটি টেস্টে টানা ব্যর্থ। খারাপ খেলতে খেলতে নিজের অবস্থান ধরে রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে। নাজমুল হোসেন শান্ত ঘাঁড়ে নিঃশ্বাষ ফেলছেন। কাজেই মুমিনুলের জ্বলে ওঠা খুব দরকার। সেটা যতটা দলের জন্য, ততটা নিজের জন্য।

মিষ্টার ডিপেন্ডেবল মুশফিকের সামর্থ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। সন্দেহাতীতভাবেই সংকটে, প্রয়োজনে তার ব্যাট সবচেয়ে কার্যকর, বিশ্বস্ত। আগামীকাল তার চওড়া ব্যাটের দিকেই তাকিয়ে থাকবে বাংলাদেশ। ওপরে লিটন, ইমরুল-মুমিনুলের একজন আর মাঝখান মুশফিকুর রহিম জ্বলে উঠলে বাংলাদেশের নৌকা সাফল্যের বন্দরে ভীড়তেও পারে।

এআরবি/এসএএস/এমএস