‘সে শেষ হয়ে হয়ে গেছে’, ‘সে খুবই বিপজ্জনক’, ‘আমরা তাকে ভালোবাসি’, ‘তিনি আমার হিরো’ - সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে নিয়ে জনমত একেবারেই বিভক্ত।
Advertisement
ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে সাংবাদিক জামাল খাশোগি খুন হওয়ার পর পশ্চিমা দেশগুলোতে ‘এমবিএস ব্র্যান্ড’ এখন আরো বিপজ্জনক হয়ে গেছে। যদিও সৌদি আরব বারবার বলছে, ওই খুনের ঘটনার সাথে প্রিন্স সালমানের কোন যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু এ অস্বীকৃতি দেখা হচ্ছে গভীর সন্দেহের চোখে।
কারণ কি? এক কথায় - যে দেশে ওপরের নির্দেশ ছাড়া প্রায় কিছুই হয় না, সেখানে কিছু নিয়মভঙ্গকারী অ্যাজেন্ট মিলে জামাল খাশোগিকে খুন করেছে, এটা শুনতে প্রায় অসম্ভব মনে হয়।
আরব দেশগুলোতে একটা ‘তত্ত্ব’ বেশ চলছে। সেটা হলো এই রকম : খাশোগি সৌদি সরকারের কড়া সমালোচক ছিলেন এবং তাই এমবিএস চেয়েছিলেন তার ব্যাপারে ‘কিছু একটা করা হোক।’ কিন্তু তিনি কখনো খুনের অনুমতি দেননি। বরং তার অফিস যিনি চালান সেই সাউদ আল-কাহতানি এমবিএসের নির্দেশের বাইরে গিয়ে হত্যাকারীদের বলেছিলেন যে, যুবরাজ সবকিছুরই অনুমোদন দিয়েছেন।
Advertisement
সমস্যা হলো সৌদি আরবের বাইরে প্রায় কেউই এ কথা বিশ্বাস করে না। কারণ এ খুনের ঘটনা নিয়ে প্রথম থেকেই সৌদি আরবের দিক থেকে একেকবার একেক রকম কথা বলা হচ্ছিল। তাই এটাই অনুমান করে নেয়া যায় যে- প্রিন্স সালমান তার মোটা-বেতন-পাওয়া মিডিয়া উপদেষ্টাদের কথা কানে শুনলেও পাত্তা দেননি।
ফলে এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে এমবিএস এখন বিশ্বজনমতের কাঠগড়ায়। পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যে তার সাথে কোন সংস্রব আছে এটা আর তারা দেখাতে চাইছে না।
কিছু পশ্চিমা সংস্থা এবং মার্কিন কংগ্রেসম্যান এখন দাবি করছেন, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক। এখন সৌদি আরব দাঁড়িয়ে আছে এক মোড় বদলকারী মুহূর্তে। কি করতে পারে দেশটি?
এখন কি সৌদি রাজপরিবারের সিনিয়র প্রিন্সরা মিলে এমবিএসের ক্ষমতা কিছু কমিয়ে দেবেন; যাতে এই বিক্ষুব্ধরা খুশি হয়? নাকি তাকে যুবরাজের পদ থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দিয়ে একটা নামমাত্র এবং অর্থহীন পদোন্নতি দেয়া হবে?
Advertisement
নাকি তারা এই ঝড় কেটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবেন? বিবিসির ফ্রাংক গার্ডনার লিখছেন, সৌদি রাজপরিবারের অন্দরমহলে, বন্ধ দরজার ওপাশে এখন এ প্রশ্নগুলো নিয়ে ‘অত্যন্ত গুরুতর’ আলোচনা চলছে।
ব্যাপারটা কত গুরুতর - তার একটা আভাস পাওয়া যায় একটি ঘটনা থেকে। ৮২ বছর বয়স্ক সৌদি বাদশাহ সালমানের একমাত্র জীবিত ভাই প্রিন্স আহমেদ বিন আবদেলআজিজ হঠাৎ করেই গত মঙ্গলবার রিয়াদে ফিরে এসেছেন। তিনি এতদিন লন্ডনে ছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন এমবিএসের বিরোধীদের মধ্যে ‘গুরুস্থানীয়’ একজন ব্যক্তি যিনি ইয়েমেনে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী করেছিলেন যুবরাজ সালমান এবং তার পিতাকে। তার ভয় ছিল - দেশে ফিরলেই তাকে গৃহবন্দী করা হবে।
গভীর রাতে রিয়াদে নামার পর প্রিন্স আহমেদ বিন আবদেলআজিজকে আগরবাতির ধোঁয়া এবং অন্য প্রিন্সদের উষ্ণ আলিঙ্গন দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়। অভ্যর্থনাকারীদের মধ্যে এমবিএসও ছিলেন। প্রিন্স আহমেদ এখন চেষ্টা করছেন পুরো রাজপরিবারকে একসাথে করতে। কিন্তু এমবিএসের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ধরণের আলোচনা করছেন তারা?
প্রথম কথা- ৩৩ বছর বয়স্ক প্রিন্স সালমানকে চ্যালেঞ্জ করার মত কেউ এখন নেই। যুবরাজ আগেই সব চ্যালেঞ্জারদের সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করেন, রাজপরিবারের রক্ষক বাহিনী ন্যাশনাল গার্ড নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রীও তিনি; তাই সৌদি সশস্ত্র বাহিনীও তার নিয়ন্ত্রণে।
রাজকীয় আদালত, অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং দেশ পরিচালনার প্রকৃত কর্তৃত্ব; এগুলোও এমবিএসের হাতে, যদিও বাদশাহ হচ্ছেন তার অসুস্থ পিতা।
বেশ কিছুদিন ধরেই এটা স্পষ্ট হচ্ছিল যে এমবিএস কোন গণতান্ত্রিক নেতা নন। তাকে জানেন এমন একজন বর্ণনা করেছেন- লোকটি আসলে ‘একজন বেপরোয়া, নিয়ন্ত্রণহীন গুন্ডা।’
কিন্তু তার অনেক বাড়াবাড়িই সৌদি আরবের মানুষ এতদিন ধরে মেনেই নিচ্ছিল। লক্ষ লক্ষ তরুণ সৌদির কাছে প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তাদের ভবিষ্যতের আশার প্রতীক। একজন সাহসী, আকর্ষণীয় নেতা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সংস্কারক - যিনি ধর্মীয় নেতাদের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছেন, মেয়েদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দিয়েছেন, সৌদি সমাজে বিনোদনের সুযোগ খুলে দিয়েছেন। তেলভিত্তিক সৌদি অর্থনীতিরও সংস্কার করছেন তিনি।
ওয়াশিংটন, লন্ডন বা প্যারিসের কূটনীতিক বা নীতিনির্ধারকদের কাছে মনে হতে পারে, প্রিন্স সালমানকে সরিয়ে দেয়া বা তাকে সংযত করাই এখন স্বাভাবিক বিকল্প। কিন্তু সৌদি আরবের রক্ষণশীল রাজপরিবার ঝুঁকি নিতে অনাগ্রহী। তারা চাইবে এরকম কিছু না করতে।
তাই এমবিএসের দিন কী শেষ হয়ে গেছে? এ পর্যায়ে এটা বলা খুবই কঠিন। ২০১১ সালের মাঝামাঝি আরব বসন্তের সময় প্রায় সবাই ভেবেছিলেন - সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ কয়েক মাসের মধ্যেই ক্ষমতাচ্যুত হবেন। তার পর সাত বছর পেরিয়ে গেছে। তিনি আজও ক্ষমতায় আছেন। বিবিসি বাংলা।
এসআইএস/আরআইপি