২০১৪ সালে ২৭ ডিসেম্বর শীতের দুপুর। খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত গ্রাম সিন্দুকছড়িতে হঠাৎ গৃহবধূ সালমার চিৎকারে ছুটে আসেন আশপাশের মানুষ। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। প্রতিবেশীরা সালমাকে তার বাড়ির উঠনে পায় আগুনে ঝলসে যাওয়া অবস্থায়।
Advertisement
সালমাকে উদ্ধার করে প্রতিবেশীরা প্রথমে হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে খবর দেয় তার বড় ভাই মো. নুরুজ্জামানকে।
তিনি জানান, অন্য যে কোনো দিনের মতো সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। দুপুরে সালমার চিৎকারে পাশের বাসার কয়েকজন ছুটে যায়। তারা তাকে ঝলসে যাওয়া অবস্থায় উদ্ধার করে। আমরা খবর পেয়ে হাসপাতালে যেয়ে দেখি তার শরীরের অধিকাংশই পুড়ে গেছে।
এ ঘটনার পাঁচ মাস পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সালমার মৃত্যু হয়। এ ধরনের আচমকা মৃত্যু আর তার কারণ জানা না থাকায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে সালমার পরিবার। পরে নিহত সালমার বড় ভাই মো. নুরুজ্জামান বাদী হয়ে স্থানীয় গুইমারা থানায় মামলা করেন।
Advertisement
তদন্তে বেরিয়ে আসে, ঘটনার আগের কয়েকদিন ধরে স্বামী মিজানুর রহমানের সঙ্গে মনোমালিন্য চলছিল সালমার। এর কারণ স্বামীর যৌতুক দাবি। কিন্তু সালমা বিষয়টি নিজেদের মধ্যে সমাধান করতে চাইলেও মিজানুর তা করেনি। বাড়ির উঠনেই পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় সালমার শরীরে।
মঙ্গলবার (৩০ অক্টোবর) সকালে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার মগপুকুরের পশ্চিম পাড়ের একটি ভাড়া বাসা থেকে মা-মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে পুলিশ বলছে, পারিবারিক কলহের জেরে স্বামী মতিনের হাতে খুন হয়েছেন পারভিন আক্তার (২২) ও তার মা হোসনে আরা (৬০)।
যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে হত্যার ঘটনায় স্বামী মিজানুরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত
এ ঘটনার মাত্র পাঁচদিন আগে ২৫ অক্টোবর রাতে নগরের ছোটপুল এলাকায় তুচ্ছ অভিযোগে স্ত্রী সুমি ইসলামকে (২০) শ্বাসরোধ করে হত্যা করে জাহিদ হোসেন রাজু (২৮)। শুধু হত্যা করেই থামেনি ওই পাষণ্ড। ঘটনা ধামাচাপা দিতে ১০ মাস সংসার করা স্ত্রীর শরীর থেকে মাথা আলাদা করে। পরে দেহ বস্তায় ভরে ফেলা হয় নালায় আর খণ্ডিত মস্তক ফেলা হয় কবরস্থানে।
Advertisement
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে মাত্র চারদিনের ব্যবধানে দুই পরিবারের মা-মেয়ে ও স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নগরবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলেছে৷ প্রশ্ন উঠেছে পারিবারিক নিরপত্তা নিয়ে৷ প্রশ্নের মুখে পড়েছে স্বজন-সম্পর্কও৷ এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড কেন বাড়ছে?
ডবলমুরিং থানায় মঙ্গলবার জোড়া খুনের ঘটনায় নিহত পারভিনের বড় বোন রেশমি জানান, দেড় বছর আগে মতিনের সঙ্গে পারভিনের বিয়ে হয়। মতিনের বাড়ি কুমিল্লায়। সিলেটে তার একটি ভাঙারি দোকান ছিল। বিয়ের পর পারভিনকে নিয়ে মতিন সিলেটে চলে যান। সেখানে পারভিনের ওপর বিভিন্ন সময় অত্যাচার করত মতিন। সে নেশাগ্রস্ত ছিল। একমাস আগে মতিন ও পারভিন চট্টগ্রামে আসে। এ সময় মতিন তার শাশুড়ি হোসনে আরার কাছে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া-মারধরের জন্য ক্ষমা চান। তখন শাশুড়ি তার বাসার পাশে বাসা ভাড়া করে তাদের রাখেন। কিন্তু কিছুদিন যেতেই মতিন আবারও পারভিনকে মারধর করতে শুরু করে। এ নিয়ে স্ত্রী পারভিন ও শাশুড়ি হোসনে আরার সঙ্গে মতিনে প্রায় ঝগড়া হতো।
রেশমির স্বামী সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মতিন সবসময় বাসায় সমস্যা করত। ঘরের খাবার ভালো নয় এ অযুহাতে কয়েকদিন আগে থেকে সে হোটেলে ভাত খাওয়া শুরু করে। এ নিয়ে একবার শাশুড়িকে ছুরি নিয়ে মারতে যায়। গত সোমবার দুপুরে শাশুড়ি ও পারভিনের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়। তাই আশঙ্কা করছি গভীর রাতে মতিন শাশুড়ি ও শালিকে খুন করে পালিয়েছে।’
পুলিশের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে পারিবারিক কলহের জের ধরে গত পাঁচ বছরে প্রায় ১০ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যার মামলা হয়েছে। সে হিসেবে প্রতিবছর মোট হত্যাকাণ্ডের শতকরা ৪০ ভাগ হয় পারিবারিক কলহের তুচ্ছ কারণে।
পর-পুরুষের সঙ্গে কথা বলার অভিযোগে স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা করেন রাজু
নগরের ছোটপুল এলাকায় স্ত্রী সুমি আক্তারকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে ঘাতক স্বামী জাহিদ হোসেন রাজু (২৮)।
তিনি আদালতকে জানিয়েছে, ‘স্ত্রী সুমি ইসলাম প্রায় সময় বিভিন্ন ছেলের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতো। এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হত। এসব ঘটনার জের ধরে ২৫ অক্টোবর রাত পৌনে ২টায় পরিকল্পিতভাবে সুমিকে প্রথমে রশি দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা এবং পরে ছুরি দিয়ে শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে।’
পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের এ সব ঘটনা যে শুধু চট্টগ্রামে ঘটছে তা নয়। সারাদেশেই প্রতিদিন কোথাও না কোথাও এমন ঘটনা ঘটছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক লাইলুন নাহার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে পরিবর্তন আসছে৷ পুরুষের আগে থেকেই সুযোগ ছিল, নারীরও এখন সুযোগ হয়েছে৷ প্রযুক্তির কল্যাণে মোবাইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্পর্কের ধারণা পরিবর্তন করছে৷ সম্পর্কের নানা দিক দেখিয়ে দিচ্ছে৷ যার প্রভাব পড়ছে আচরণে৷ ফলে পারিবারিক কলহ বাড়ছে৷ আর বাড়ছে নৃশংসতা৷ আমরা পরিবর্তনের সঙ্গে মূল্যবোধ ও মানবিকতাকে সমানভাবে ধরে রাখতে পরছি না৷’
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দাম্পত্য কলহ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, যৌতুক, মাদকাসক্ত এসব বিষয় পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ হিসেবে রয়েছে।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কফিল উদ্দিন বলেন, ‘সমাজে অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বিচারহীনতা। বিচারহীনতা সমাজে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে৷ এখন নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীন। সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে, রাষ্ট্রে সুশৃঙ্খলা রাখতে ও বাসযোগ্য করতে হলে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে শক্ত করতে হবে৷ শুধু আইন দিয়েই সব কিছু হবে এমনটা ভাবা ঠিক হবে না৷’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) আমেনা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে সারাদেশেই পারিবারিক কলহের কারণে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাড়ছে৷ পারিবারিক কলহের পিছনে প্রধান দু'টি কারণ হলো-স্বামী বা স্ত্রীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক এবং সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব৷ যৌতুক, অর্থনেতিক অস্বচ্ছলতা বা অধিক স্বচ্ছলতাও পারিবারিক কলহ সৃষ্টি করে। আর এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নৃশংসতার অন্যতম কারণ অসহিষ্ণুতা।
এএইচ/এমএস