আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখা, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্মদিন আজ। প্রিয় এ কবির প্রতি প্রাণভরা শ্রদ্ধার্ঘ্য। যে কথাগুলো ছোটবেলা থেকেই আমাকে আন্দোলিত করতো, যে শব্দগুলো শিশুতোষ সরল মনে বিপ্লবের চেতনা জাগায়- সেগুলোই রুদ্রের শব্দচয়ন, কাব্যধারা। ছোটবেলায় জীবনে প্রথম কবিতার প্রেমে পড়ি রুদ্রের কবিতা পড়ে। রুদ্র আমার জীবনের এক অজানা হিরো। রুদ্রকে আমি দেখি ভিন্ন চোখে। কবিতাপ্রেমী এ চোখে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক অনন্য নাম। রুদ্র আমার ছোটবেলার প্রেম, আমার শৈশবের ভাললাগা। কবিতার প্রেমে পড়ি সর্বপ্রথম বাবার দেয়া রুদ্র'র কবিতা- উপহার থেকে। সেটা ১৯৯১ সালের ঘটনা। অথচ সে বছরই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে, সবাইকে কাঁদিয়ে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ক্লাশে ফার্স্ট হওয়ায় পুরস্কার হিসেবে পেয়ছিলাম রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা ও সুকান্ত ভট্টাচার্য এর ছাড়পত্র কাব্যগ্রন্থ। বই দুখানি অ দারুণভাবে প্রাণিত করেছিল। জীবনকে বদলে দিয়েছিল এই কাব্যগ্রন্থগুলো। অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিগোষ্ঠীকে স্বাধিকার, স্বকীয়তা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ শিখিয়েছে এইসব অমর কবিতাবগুলি। এরা কত বড় ত্যাগী পুরুষ ছিলেন। এরা জীবনের সর্বস্ব দিয়ে কবিতা সৃজন করেছেন। একের পর এক প্রসব করেছেন অবিনাশী কবিতা, তারুণ্যের কাব্যগাথা। আজ মনে পড়ে গেল আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, বাংলাদেশের নাট্যাচার্য বিশ্ববরেণ্য অধ্যাপক ও নাট্যকার শ্রদ্ধেয় ড. সেলিম আল দীন স্যার এর একটি বক্তব্যের কথা। আফগান যুদ্ধ,কান্দাহার এটাক ও মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদে যখন বিশ্ব মানবতা ফেঁপে উঠেছিল মার্কিনীদের বিরুদ্ধে, ঠিক তখন,জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চের প্রায় দশ হাজার দর্শক সমাগমের এক বিশাল জনস্রোতের মাঝে এক প্রতিবাদ সমাবেশে স্যার বলেছিলেন- আমরা তাদের চেয়ে দুর্বল,তাদের সাথে হয়তো যুদ্ধ করে পারবো না,কিন্তু আমাদের বিবেক কে জাগ্রত করতে দোষ কোথায়,বিশ্ব বিবেক কে জাগিয়ে তুলতে দোষ কোথায়?
Advertisement
আমরা কি পারিনা,তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সূঁচালো কলম ধরতে? আমরা কি পারিনা কলমের শৌর্যে, কালির তান্ডবে তাদের মুখে চুনকালি দিতে, যারা বিশ্ব মানবতার আততায়ী? আজো কানে ভাসে প্রিয় স্যারের সুস্পষ্ট কণ্ঠস্বর। এ মৃদুভাষী মানুষটার মুখে সেদিন ভূয়সী প্রশংসা শুনেছিলাম প্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার প্রতিবাদী কবিতা আর অবিনাশী গানের। প্রিয় কবি তুমি ঘুমাও শান্তিতে,তোমার ওপারের জীবন সুখময় হোক। তোমার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
অকাল প্রয়াত এই মহান ক্ষণজন্মা কবি তার কাব্যযাত্রায় যুগপৎ ধারণ করেছেন দ্রোহ ও প্রেম, স্বপ্ন ও সংগ্রামের শিল্পভাষ্য। অসম্ভব প্রতিবাদী বাংলার আরেক বিদ্রোহী কবি বাংলার মানুষের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিলেন বিপ্লবের হাওয়া। অদম্য উদ্দীপনা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সাহস ও স্বপ্নে, শিল্প ও সংগ্রামে আপাদমস্তক সমর্পিত এই কবি তার স্বল্পায়ু জীবনকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তারুণ্যের দীপ্র সড়কে।
নিজের জীবনের সবটুকো আলো ছড়িয়েছেন অন্ধকারাবৃত মানবগোষ্ঠী কে আলোকিত করতে। নিজেকে মেলে ধরেছিলেন নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে। নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছিলেন আপামর নির্যাতিত মানুষের আত্মার সঙ্গে; হয়ে উঠেছিলেন তাদেরই কণ্ঠস্বর। শুধু দীপ্যমান মংলা নয়, দীপ্যমান বাগেরহাট, খুলনা নয়, দীপ্তি জ্বালিয়েছিলেন এপার বাংলা ও ওপার বাংলায় তার কবিতার শাণিত ধারায়।
Advertisement
আজো শরীরে কাঁপন ধরে কবির সে অমর কাব্য শুনলে 'জাতির পতাকা আজ খাঁমচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’– এই নির্মম সত্য অবলোকনের পাশাপাশি ততোধিক স্পর্ধায় তিনি উচ্চারণ করেছেন- ‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই’। যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাঁকে পরিণত করেছে ‘তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক’-এ। শুধু বিপ্লবই নয়,তিনি প্রেমের কবিও।
তার প্রেমের কবিতাও হৃদয়ে শীতল অনুভূতির পরশ বুলায়। একই সঙ্গে তাঁর কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা। অসম্ভব সৌন্দর্যের পূজারী ছিলেন তিনি। তার জীবনকে তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন সৌন্দর্য আহরণে,নারীর সৌন্দর্য নয়,মানুষের মেধা ও মননের সৌন্দর্যের জন্য। মানুষের হৃদয়ের সুকোমল অনুভূতি আহরণের জন্য।
রুদ্রের ভাল আছি ভাল থেকো গানটি সারা পৃথিবীর সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হৃদয়ে প্রেম ও দ্রোহের দোলা লাগিয়েছিল।
মাত্র ৩৪ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ সহ অর্ধ শতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন।
Advertisement
এইচআর/এমএস