শারদীয় দুর্গোৎসব চলছে। বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর উৎসব হলেও দুর্গাপূজা আপামর বাঙালির উৎসবের সঙ্গে খুউব সুন্দর ভাবে মিলেমিশে গেছে। অথবা বলা যায় যে গিয়েছিল। যদিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় খরচবহুল দুর্গাপূজা পালন পাড়ায় পাড়ায় হতো বলে তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার সঙ্গে দুর্গাপূজা উদযাপনও যে অনেকটাই আগের তুলনায় বেড়েছে তা গত বছর আটেক ধরে দেখা যাচ্ছে।
Advertisement
এর সঙ্গে কি বাঙালির ধর্মচেতনায় একটু হলেও উদারতা যোগ হয়েছে কিনা সে প্রশ্ন তোলার সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্ন দিয়েও আলোচনা শুরু করতে চাই যে, রাষ্ট্র ক্ষমতায় একটি স্ব-স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ দল আসীন থাকলে কি পরিস্থিতির অদলবদল ঘটে কিনা? যদিও এ আলোচনায় তুলনামূলক কোনো ডেটা বা উপাত্ত উপস্থাপন করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্র- আমরা বাক্য মুখে বললেও, এই রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধে যে সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রবাদের ইন্ধন রয়েছে তা মোটাদাগে আমরা বলতে পারি। আমরা একথাও জানি যে, সংখ্যালঘুর ধর্মপালনের স্বাধীনতায় এদেশে স্বাধীনতার আগে যেমন হস্তক্ষেপ হয়েছে তেমনই স্বাধীনতার পরও এদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকারটুকু সম্পূর্ণভাবে ভোগ করতে পারেনি।
বিশেষ করে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের হাতে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় নেওয়ার পর এবং জেনারেল এরশাদের হাতে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংযুক্তির পর অন্য যে কোনো ধর্মবিশ্বাসীরাই মূলতঃ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয় এবং রাষ্ট্র সাদা চোখে সংখ্যাগুরুর শক্তিকেই মেনে নেয়।
Advertisement
বহুদিন ধরে দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার নাগরিকেরা রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি সংবিধান থেকে এই ভয়াবহ বৈষম্য দূরীকরণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু কখনোই সংবিধানকে তা থেকে মুক্ত করা যাচ্ছে না। এমনকি আওয়ামী লীগের মতো স্ব-স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলও যখন দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় বসে তখনও তাদের পক্ষে সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা কিংবা রাষ্ট্রধর্মকে বাদ দেওয়া সম্ভবপর হয় না।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ধর্মকে আলাদা করার জন্য তাত্ত্বিকরা বহু যুগ ধরেই এ প্রশ্ন তুলে আসছে যে, রাষ্ট্রের আবার নির্দিষ্ট করে ধর্ম থাকতে হবে কেন? রাষ্ট্রতো সবার এবং সেখানে ধর্মবর্ণজাতিভেদ সব তুচ্ছ হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা নিজেদের আধুনিক দাবি করেও ভোটের রাজনীতির কাছে এখানে হেরে বসে থাকি এ কারণে যে, রাজনৈতিক দলগুলোকে যখন ভোট চাইতে মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয় তখন ভোটাররা যদি মনে করে যে, তাদের ধর্মকে কোনো ভাবে কোথাও খাটো করা হয়েছে তাহলে নিশ্চিত ভাবেই সে ভোটটি আর আসবে না।
এক্ষেত্রে যদি সংখ্যাগুরুর ধর্ম সংখ্যালঘুর ধর্মকে স্থান করে দিতে না চায় তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণতঃ সংখ্যাগুরুর দিকেই ঝুঁকে থাকে। তারা মনে করে যে, সংখ্যালঘুকে কোনো না কোনো বোঝানো যাবে কিন্তু সংখ্যাগুরুর ভোট না পেলেতো ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ত্রুটি হিসেবে এই সংখ্যাগুরু-তোষণ এখন সবচে বড় বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি করেছে পৃথিবীময়।
আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণেই দেখি যে, দেশের রাজনীতি মোটামুটি দু’টি বড় ভাবে বিভক্ত। একপক্ষ মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি করে আর অন্য পক্ষটি কোনো রাখঢাক না করেই বলে যে, তারা আসলে একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মের নামে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চায় কিন্তু সেখানে তারা সংখ্যালঘুর জন্য জায়গা রাখবে, সেটা অনেকটা দয়া-দাক্ষিণ্যের মতো করেই।
Advertisement
নিজেদের আধুনিক প্রমাণ করতে দলেও তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে অংশীজন রাখে বটে কিন্তু তাদের গুরুত্ব কতোটা দেওয়া হয় তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। অপরদিকে যারা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দাবী করছে তার এখনও পর্যন্ত নিজেদের এই চরিত্র অনেক রকম ত্রুটি-বিচ্যুতির পরও টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু তারাও যে শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগুরুর ভোটের রাজনীতির কাছে আত্মসমপর্ণ করছে তার চিহ্ন এদেশে স্পষ্ট।
হেফাজতে ইসলামের মতো একটি চূড়ান্ত ধর্মাশ্রয়ী উগ্রবাদী শক্তির সঙ্গে আওয়ামী লীগের মতো একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির সম্পর্ক যে কোনো সুশীল চিন্তাকে আহত করবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ভোটের রাজনীতিতে এই বিশাল ভোটব্যাংক কোনো না কোনো রাজনৈতিক শক্তির পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, সেক্ষেত্রে হার হবে দেশের আপাতঃ বা মোটামুটি অসাম্প্রদায়িক শক্তিটিরই। আমরা এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারছি না এবং এর কাছেই অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে আমাদের সকলেই।
কিন্তু তারপরও আশা থাকে। সেটা কী রকম? বাংলাদেশে ধর্মীয় উৎসব যে সর্বজনীন রূপ ধরে আসে তা সর্বার্থে সত্য নয়। বরং ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে এদেশে সম্প্রদায়গত বিভেদ বা সংঘর্ষও বেশ পুরোনো রীতি। আশির দশকে সামরিক শাসনকাল থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকে পুনরায় গণতন্ত্র ফিরে আসার পরও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় নির্বিঘ্নে এবং কোনো রকম ভীতিহীন পরিবেশে দুর্গাপূজা পালন করতে পেরেছে বলে প্রাপ্ত তথ্যাদি আমাদের নিশ্চিত করে না। বরং সংবাদপত্রের খবর থেকেই জানা যায় যে, মূর্তি ভাঙা এবং মণ্ডপ বিনষ্ট করায় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা রাষ্ট্রের কাছে এক প্রকার গ্রহণযোগ্যতাই পেয়ে যাচ্ছিলো।
২০০১ সালে নির্বাচনে বিজয়লাভ করেই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের খড়্গ নেমে এসেছিল তা ছিল ভয়ঙ্কর ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চরিত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। কিন্তু পরবর্তীতে নির্বাচনে বিজয় লাভ করে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারটি সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছে সম্পূর্ণ ভাবেই।
কেন সে কাজটি আওয়ামী লীগ করেনি সে প্রশ্ন আমরা তুলতে পারি এবং ধারণা করতে পারি যে, সংখ্যাগুরুকে তারা চটাতে চায়নি। কারণ হয়তো ২০০১ সালে যারা বিএনপি-জামায়াতের হয়ে সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল তারাই আজকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে।
মানুষ একই আছে, রাজনৈতিক পরিচিতি বদলেছে কেবল। এবং সমস্যাটি আসলে সেখানেই। রাজনৈতিক পরিচিতি বদলে ফেললেই যে, ভেতরকার কুৎসিত সাম্প্রদায়িক চরিত্র বদলানো যায় না সেটাতো সত্য, এই সত্য মেনে নিয়েও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, অন্ততঃ আওয়ামী লীগের বিগত দুই শাসনামলে দুর্গাপূজা একটা সর্বজীন উৎসবে রূপ নিয়েছে এবং শরৎ এলেই বাংলার প্রকৃতির মতোই রাজধানীসহ সারা দেশে এক অভাবনীয় রূপরসগন্ধের উৎসবের আমেজ তৈরি হয়- এ আমেজ আর কিছুই নয়, বাঙালি মেতে ওঠে সর্বজীন শারদীয় দূর্গোৎসবে।
এই উৎসবকে রাষ্ট্র নিরাপত্তা দেয় এবং প্রস্তুতি নিয়েই (অনেক নিয়ম-কানুন বেঁধে দিয়েও) নির্বিঘ্নে যাতে পার্বণটি পার করা যায় তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। এই নিশ্চয়তা পেয়েই যে, হিন্দু সম্প্রদায় এতো খরচবহুল পূজার আয়োজন করতে পারে সেটাও আমরা বুঝতে পারছি।
কিন্তু এর মাধ্যমে সবচেয়ে যে উপকারটি হচ্ছে তাহলো, বাঙালির দুই প্রধান ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে উৎসবের আদান-প্রদানের বিষয়টি ক্রমশঃ উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে, পূজা মণ্ডপে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ থাকায় পাড়া-মহল্লা থেকে সকলেই অন্ততঃ কৌতূহলী হয়েও যখন ঠাকুর দেখতে যায় কিংবা এই উৎসবের ভেতর থেকেই পূর্জা-অর্চণার বিভিন্ন পদ্ধতিসমূহ দেখে তখন যে কোনো অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে থাকা ভীতি বা অবহেলা কেটে যায় বা কেটে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
আমি একথা জোর দিয়ে বলতে পারছিনে যে, এর ফলে বাঙালি রাতারাতি ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাপম্প্রদায়িক হয়ে যাবে কিন্তু আগেই একথা বলেছি যে, এই যে দেশব্যাপী দেবীপক্ষ পালন, মিডিয়াতে দুর্গাপূজার বিবিধ আয়োজনের বিস্তারিত বর্ণনা ও বিভিন্ন মণ্ডপ থেকে সরাসরি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আওয়াজন প্রচার হওয়া বাঙালি-মনে খানিকটা হলেও প্রভাব ফেলে যে, এই আয়োজন যতোটা না ধর্মীয় তার চেয়ে অনেক বেশি সংস্কৃতিগত- এটাই বাঙালি এবং এটাই বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম পরিচয়।
প্রশ্ন হলো, আমরা কি এই অকৃত্রিম চারিত্রিক পরিচয়টি বজায় রাখতে চাই কিনা? নাকি একটি আরোপিত ধর্মভিত্তিক পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই? রাজনৈতিক ভাবে যদি দেখি তাহলে আমাদের বিভক্ত রাজনীতি সাধারণ মানুষকে এই বিতর্কের ভেতর ফেলে রেখে বিভ্রান্ত করতে চায় এবং এর ফায়দা লুটতে চায়। কিন্তু এওতো সত্য যে, বাঙালির দৃঢ়তার কাছে অনেক বারই এই বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টাকারীরা পরাজিতও হয়েছে।
আশাটা আসলে সেখানেই। আমরা আশাবাদী জাতি অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে, জাতিগত-ধর্মীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রেও। এই শারদোৎসব আমাদের এই আশাবাদকে আরো চাগিয়ে দেয় বলেই এবারও আমার মনে হয়েছে। নাহলে এরকম নির্বাচনের একেবারে প্রান্তসময়ে দাঁড়িয়ে, দেশব্যাপী এরকম নির্বিঘ্ন দূর্গোৎসবের আয়োজন আগামি দিনগুলিতে বিশাল আশাবাদের ভিত্তি ছাড়া সম্ভবপর হতো না। তার মানে হচ্ছে, রাষ্ট্র চাইলেই অসাম্প্রদায়িক হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রকে সেটা চাইতেতো হবে, তাই না?
সবাইকে শারদীয় দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা।
ঢাকা ১৬ অক্টোবর, মঙ্গলবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/পিআর