রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে আলোচনা বিস্তর। এখানে হিংসা মানে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। হিংসাদীর্ণ আমাদের রাজনৈতিক এই যে সংস্কৃতি, তাতে আলাদা অবস্থানে আছে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট।
Advertisement
এর মধ্যে একুশে আগস্টকে আলাদা করতে হবে সবকিছু থেকে। লক্ষ্যপ্রাপ্তির জন্য সামগ্রিক শাসনব্যবস্থা কিংবা শাসক নিজেই যখন হিংসার মাঠে খেলোয়াড় হয়, তখন তাকে বলা হয় ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সেসময়ের সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা করেছিল সরকারি দল, সরকারি সংস্থা আর বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ।
১৪ বছর পর একটি রায় হয়েছে। রায়ে কার কী সাজা হয়েছে সে নিয়ে বেগ ও আবেগ আছে। কিন্তু একথা এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, যার যে মেয়াদেই সাজা হোক না কেন, তারা আদালতে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন।
তারেক রহমানের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। তিনি এ মুহূর্তে দলের প্রধান। দলের সাবেক প্রধান দুর্নীতি মামলায় জেলে। প্রশ্ন হলো ভালো মানুষ বলে খ্যাত কিছু রাজনীতিকতো এখন খুনি বলে প্রমাণিত নেতৃত্বের সাথে ঐক্য করতে উদ্যত হয়েছে। ক্ষমতার লোভ এমন যে, এমন একটি ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়েছে যারা, তাদের দলকে ক্ষমতায় আনতে এরা সব এক হয়েছে!
Advertisement
সরলরেখা আঁকতে দুটি বিন্দু প্রয়োজন। কিন্তু রাজনীতি যে, সরলরেখায় চলে না তার প্রমাণ এই ঐক্য আর জোট খেলা। যারা নিজেদের সৎ বলে দাবি করেন, সুশাসনের কর্ণধার বলে প্রচার করেন, তারা যখন একজন প্রমাণিত খুনি আর দুর্নীতিবাজের সাথে মিলে সরকার উৎখাত করতে মাঠে নামে তখন আমাদের রাজনীতির আগামীকাল কাল কিংবা গতিপ্রকৃতির পূর্বাভাস করা বিপজ্জনক।
এই হামলা আর তার মামলার রায় পর্যবেক্ষণ করলে আমরা কয়েকটি নাম পাই। প্রথমেই আসা যাক তারেক রহমানের কথা। তিনি সেসময় দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা, দলের প্রধান ও দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে। সরকার তা মা চালালেও তার নিজস্ব এক ব্যক্তিগত সচিবালয় থেকেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত আসত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আর সচিবালয়ের কাজ ছিল সেসসব বাস্তবায়ন করা। হাওয়া ভবনের দুর্নীতি রূপকথার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে-বিদেশে।
আরেকজনের নাম হারিছ চৌধুরী, যিনি ছিলেন সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব। মন্ত্রী পদমর্যাদায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসে তারেক রহমানের নির্দেশ বাস্তবায়নকারী এখন পলাতক। তার বিরুদ্ধে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এ এম কিবরিয়াকে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগও আছে।
একসময় চোলাচালানের সাথে জড়িয়ে থাকা নাম লুৎফুজ্জামান বাবর হয়ে গেলেন জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তার কুকীর্তির কথা আলোচনা না করাই উত্তম। কিন্তু আরও সব নামের সাথে দুটি নামতো উল্লেখ করতেই হয়। একজন হলেন সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী কায়কোবাদ, যাকে তার এলাকায় ডাকা হয় সন্ত্রাসের বরপুত্র। তার আরেক পরিচয় যে, তিনি ইয়েমেন কেন্ত্রিক যে আফ্রিকান সন্ত্রাসী জঙ্গি গ্রুপ আছে, তাদের বাংলাদেশ সমন্বয়কারী। আরেকজন হলেন মাজেদ ভাট। পাকিস্তানি জঙ্গি নেতা।
Advertisement
এমনসব ব্যক্তি আর দল যেই জোটে যাবে তাকে সুশীলদের ঐক্য প্রক্রিয়া বলতে হবে, সেই ভাবনার মধ্যে অসততা আছে। ড. কামাল হোসেন বা বদরুদ্দোজা চৌধুরীরা বলছেন তারা সুশাসন ফিরিয়ে আনতে একত্র হচ্ছেন। কিন্তু তারা নিজেরাও জানেন এই কথায় যতখানি রাজনৈতিক ভঙ্গি বা কৌশল আছে, ততখানি সত্য নেই। সত্য হলো তারা শেখ হাসিনার শাসনের অবসান চান, যাকে তার দলের পুরো নেতৃত্বসহ নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন তারেক রহমান ও বেগম খালেদা জিয়া।
বিএনপির সাথে জোট থাকলে আপাতত সমস্যা নেই। সমস্যা হলো আওয়ামী লীগকে ছুড়ে ফেলতে চান তারা, মিলছেন তাদের সাথে যারা আওয়ামী লীগের পুরো নেতৃত্বকে খুন করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিতে হাত ধরতে আগ্রহ এখন এই দুইপক্ষের। নির্বাচনী রাজনীতিতে এই পাটিগণিত কতটা প্রযোজ্য হবে, অন্তত নৈতিকতার প্রশ্নে? আপনি নৈতিকতার কথা বলবেন, আবার হাত মেলাবেন তাদের সাথে সেটা আর যাই হোক, ন্যায্যতার কথা বলে না। বস্তুনিরপেক্ষভাবে বিচার করলে বলতেই হবে, এই মানুষগুলোর ষড়যন্ত্র সামর্থ্য ছাড়া আর কোনো সাফল্য নেই। এদের নিজস্ব কোনো সংসদীয় আসন নেই। অর্থাৎ জনগণ তাদের ভোট দেয় না। ভোট পেতে, যদি খুনির সাথে যেতে হয়, যদি তাদের মার্কা ব্যবহার করতে হয়, তবে সেই দলে যোগ দেয়া বেশি শ্রেয়।
এই নেতাদের মতো বড় মাপের মানুষরা যদি এমন ক্ষুদ্র প্রত্যক্ষ প্রাপ্তিকেই বেশি গুরুত্ব দেন তাহলে দেশের মানুষ নিজেদের প্রাপ্তির সব সম্ভাবনাকে বলি দিতেই পারেন। রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সাথে তাদের জোট অপরিহার্য কিনা তা সময়ই হয়তো বলবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/বিএ/এমএস