উচ্চ মূল্যের কারণে সাপের বিষকে তরল ডায়মন্ড বলা হয়। কারণ এক গ্রাম সোনার বর্তমান বাজারদর চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা সেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের দেশীয় সাপ থেকে প্রক্রিয়াজাত করা এক গ্রাম ভাইপার রাসেলের বিষের মূল্য প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এছাড়া কালাচ বা কালচিতি সাপের বিষের মূল্য তিন থেকে চার লাখ টাকা, খয়া গোখরার ৫০ হাজার টাকা, বিভিন্ন সামুদ্রিক সাপের বিষের মূল্য প্রায় চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা।
Advertisement
বাংলাদেশে ১৬টির অধিক প্রজাতির বিষধর সাপ আছে, যাদের বিষ অত্যন্ত মূল্যবান। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আরও পড়ুন >> ৫ হাজার মিলিয়ন ডলারের বাজারে নেই বাংলাদেশ
সাপের বিষ কেন এত দামি? এর প্রধান দুটি কারণ হচ্ছে- মানুষের জীবনরক্ষাকারী ওষুধ তৈরি করতে সাপের বিষ ব্যবহার হয়। সাপেকাটা রোগীদের জন্য সাপের বিষ দিয়েই যেমন এন্টিভেনম তৈরি হয় তেমনি ক্যান্সার, হার্টের রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগের জন্য সাপের বিষ ব্যবহার করে তৈরি হয় অনেক দামি ওষুধ।
Advertisement
বিশ্ব প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে প্রায় দেড় লাখ মারা যান। সাপেকাটা রোগীদের জন্য ব্যবহৃত ভ্যাকসিন এন্টিভেনম খুবই দামি। একটি এন্টিভেনমের মূল্য প্রায় ১৫০০ ডলার। যদিও প্রতিটি দেশের সরকার ভর্তুকি দিয়ে তা সাধারণের কাছে সরবরাহ করে।
কিং কোবরা
বাংলাদেশসহ অধিকাংশ দেশ এ ভ্যাকসিন তৈরি করে না। বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। এছাড়া সাপের বিষ দিয়ে তৈরি ওষুধও চড়া দামে আমাদের আমদানি করতে হয়।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মাদকাসক্তদের কাছে দিনদিন সাপের বিষের চাহিদা বাড়ছে। মূলত যাদের আসক্তি একেবারে চরমে, সাধারণ মাদকে যাদের নেশা হয় না তারা কড়া নেশার জন্য সাপের বিষ ব্যবহার করেন। এছাড়া উন্নত মাদকে ব্যবহৃত হচ্ছে সাপের বিষ।
Advertisement
অনেক দেশের মানুষ সাপের বিষের ফোঁটা জিভের ডগায় দিয়ে নেশা করেন। চীনে এমন কিছু অঞ্চল আছে যেখানকার মানুষ চিরযৌবন লাভের আশায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের সাপের বিষ নিয়মিত গ্রহণ করেন। তারা সাপের বিষের নিয়মিত গ্রাহকও।
সাপ থেকে বিষ সংগ্রহ করা হচ্ছে
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাপের বিষের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক। দেশে বৈধ উপায়ে সাপের খামার তৈরির অনুমতি না থাকায় বৈধ উপায়ে সাপের বিষ রফতানিরও সুযোগ নেই। এ কারণে অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকার সাপের বিষ পাচার হচ্ছে দেশের বাইরে। বাংলাদেশসহ এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বিষধর সাপ হচ্ছে কিং কোবরা। এর বিষ রসায়ন গবেষণাগারে একটি মূল্যবান উপাদান। কোবরার বিষ অনেক রোগের প্রতিষেধক তৈরিতে গবেষণাগারে বিক্রিয়ার প্রভাবক ও অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
কোবরার বিষ নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় ব্যবহৃত প্রভাবক ও অনুঘটক তৈরিতে কাজ করে। এ কারণে উন্নত বিশ্বের যেসব দেশ নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে রাসায়নিক উপাদান তৈরি করে সেসব দেশে কোবরার বিষ মহামূল্যবান। এছাড়া কোবরার বিষ বায়োকেমিক্যাল (বায়ু জীবাণুযুক্ত অস্ত্র) অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে। এ কারণে উন্নত বিশ্বে এ বিষের ব্যাপক চাহিদা।
সাপের বিষসহ চামড়া ও মাংসের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য প্রায় পাঁচ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার। হাজার মিলিয়ন ডলারের এই বাজারে বৈধভাবে প্রবেশ করতে পারছে না বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশে বৈধভাবে সাপের খামারের কোনো অনুমতি দেয়া হয় না। এ কারণে বিষ, মাংস বা চামড়া বিশ্ববাজারে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।
উদ্ধার করা সাপের বিষ
বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যে সাপের খামার দিয়ে সফল হয়েছে। কিন্তু তাদের চেয়ে আমাদের উন্নত পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও সাপের খামারের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশে উৎপাদিত সাপের বিষ, চামড়া ও মাংসের মান বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক উন্নত। এ বিষয়ে সরকার সুদৃষ্টি দিলে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
আরও পড়ুন >> সাপের খামার এখন গলার কাঁটা
তবে বর্তমানে শিক্ষিত অনেক যুবক নিজ উদ্যোগে খামার করছেন। তারা বলছেন, আমাদের দেশের কোবরা (গোখরা) অত্যন্ত বিষধর। এ সাপের বিষ খামারের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করলে বছরে কোটি টাকার রাজস্ব অর্জন করতে পারে সরকার। এটির জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক ট্রেনিং সেন্টার, গবেষণা সেল, প্রশাসনিক সেল ও ইকোলজিক্যাল সেল গড়ে তোলার পাশাপাশি শিক্ষিত যুবকদের খামার তৈরির অনুমতি দিতে হবে।
তবে সরকার অনুমতি না দিলেও থেমে নেই সাপ ও সাপের বিষের পাচার। এর পুরোটাই হচ্ছে অবৈধ পথে। ফলে বৈধভাবে সম্ভাবনাময় এ শিল্পের খামার যেমন গড়ে উঠছে না তেমনি সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। প্রতিনিয়ত শত কোটি টাকার সাপের বিষ পাচার হচ্ছে দেশের বাইরে৷
বিগত বছরগুলোতে কয়েকশ কোটি টাকার সাপের বিষ চোরাকারবারিদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে র্যাব, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একটি চক্র পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশকেও ব্যবহার করছে। গত ১০ বছরে সাপের প্রায় পাঁচশ কোটি টাকার বিষসহ বেশ কয়েকজন চোরাকারবারিকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
উদ্ধার করা সাপের বিষ
গত বছর (২০১৭ সালে) রাজধানী থেকে ১২ পাউন্ড সাপের বিষ জব্দ করে পুলিশ। যার আনুমানিক মূল ছিল ৬৮ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৬ সালের ২ আগস্ট বিজিবি চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রায় ১২ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষসহ মোহাম্মদ সোহেল নামে (৪০) এক ব্যক্তিকে আটক করে। ওই বছর ৭ মার্চ র্যাব-১০ রাজধানীর লালবাগে অভিযান চালিয়ে ১২ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করে। এর বাজারমূল্য আনুমানিক ৫০ কোটি টাকা। র্যাব-৯ ২০১৫ সালের ২৪ জুলাই সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার রাউত গ্রাম থেকে ১২ পাউন্ড গোখরার বিষ উদ্ধার করে, যার মূল্য ছিল আনুমানিক ৪৬ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জয়পুরহাটের একটি আবাসিক হোটেল থেকে ১২ পাউন্ড কোবরার বিষ উদ্ধার করে র্যাব-৫, যার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরা থেকে ছয় বোতল সাপের বিষ উদ্ধার করে পুলিশ, যার মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। ২০১০ সালে মতিঝিল থেকে র্যাব দুই আউন্স সাপের বিষ উদ্ধার করে। ২০০৯ সালের আগস্টে কারওয়ান বাজারের একটি আবাসিক হোটেল থেকে ১২ আউন্স সাপের বিষ উদ্ধার করে র্যাব। ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পাবনার ফরিদপুর উপজেলা থেকে ১২ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করে র্যাব-১২।
২০১৬ সালে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষ উদ্ধার করা হয় পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি থেকে। জলপাইগুড়ি বনবিভাগ তখন সংবাদমাধ্যমকে জানায়, আমাদের কাছে খবর ছিল যে, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করছে সাপের বিষ। এমন খবরের ভিত্তিতে নজরদারি করে বিষের বড় এ চালান জব্দ করা হয়।
সাপের বিষসহ আটক এক চোরাকারবারি
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানান, শুধু সাপের বিষ নয়, এর মাংস ও চামড়া পাচার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সাপ পাচারের সঙ্গে জড়িত বেশির ভাগই বেদে সম্প্রদায়। দেশে প্রতিনিয়ত সাপ ধরছে বেদেরা কিন্তু এ সাপ যাচ্ছে কোথায়? অভিযোগ আছে, সাপুড়েদের কাছে কিছু সাপ বিক্রির পর উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন >> আশীর্বাদ হতে পারে সাপের বিষ
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাপের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধে শিগগিরই সরকারিভাবে এর উৎপাদন ও রফতানির অনুমোদন দিতে হবে। তাহলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে সাপের বিষ রফতানি করে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। এতে বন্ধ হবে অবৈধ পাচার বাণিজ্য।
সাপের বিষ নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা করছেন রাবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. আবু রেজা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘খামারের অনুমতি দিলে সাপের চোরাচালান যেমন বন্ধ হবে তেমনি রক্ষা পাবে পরিবেশ। যেহেতু এখানে বড় অংকের একটা লেনদেন আছে তাই চোরাকারবারিদের নজর এদিকে থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে বৈধ পথ খুলে গেলে তা থেমে যাবে।’
দেশে বিভিন্ন সময় কোটি কোটি টাকার সাপের বিষের চালান ধরেছে র্যাব। র্যাব- ৯ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, বিষসহ সাপ পাচার করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। আমাদের জীববৈচিত্র্য রক্ষার ব্যাপারে র্যাব সবসময় সজাগ আছে এবং সর্বোচ্চ নজরদারিও রাখছে। বিভিন্ন সময় সাপের বিষসহ বন্যপ্রাণী চোরাকারবারিদের ধরছে র্যাব।
র্যাবের হাতে জব্দ হওয়া সাপের বিষ
পাচার বন্ধে সাপের খামারের অনুমতি দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খামারের অনুমতি দেয়া উচিত কিনা- তা সরকার বিবেচনা করবে। তবে অনুমতি থাকলে অবৈধ পথে চোরাচালান কমে যাবে।’
সাপের খামারের অনুমোদন এবং চোরাচালান প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের পরিচালক মিহির কুমার দো জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারী নীতিমালায় বৈধ রফতানির সুযোগ থাকলে অবশ্যই চোরাচালানিদের দৌরাত্ম্য কমবে।’
‘শুধু সাপ বা সাপের বিষ নয় যেকোনো বন্যপ্রাণীর অবৈধ পাচারের বিপক্ষে কাজ করছে বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিট। ইতোমধ্যে বনবিভাগ সাপের খামারের ব্যাপারে কাজ শুরু করছে। এ নিয়ে উচ্চপর্যায়ে পর্যালোচনা চলছে’- বলেন মিহির কুমার দো।
এমবিআর/এমএআর/জেআইএম