অর্থনীতি

জলবায়ু পরিবর্তন : প্রস্তুত কি পোলট্রি শিল্প?

>> জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির শীর্ষে বাংলাদেশ>> তাপমাত্রার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মাংস ও ডিম উৎপাদনে>> পরিবর্তনজনিত প্রভাব থেকে বাঁচতে এখনই পদক্ষেপ প্রয়োজন

Advertisement

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের উপকূলবর্তী যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন, বাংলাদেশ তার অন্যতম। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হবে এবং প্রায় তিন কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে নদী ভাঙন, প্রভাব পড়েছে জীববৈচিত্র্যে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবার আগে পড়ে শস্য জাতীয় ফসল, মাছ ও প্রাণিজ সম্পদ খাতে। এসব খাতে ব্যাপক সাফল্য আসলেও যেকোনো সময় তা ম্লান হতে পারে।

তারা বলছেন, দেশে প্রাণিজ আমিষ জোগানে সবচেয়ে বড় খাত পোলট্রি শিল্প। বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে যেকোনো সময় বেকায়দায় পড়তে পারে খাতটি।

Advertisement

মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কৃষি খাতে বাংলাদেশের সাফল্য ব্যাপক। বিশেষ করে আমিষের চাহিদা মেটাতে মাছ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে প্রচুর সফলতা এসেছে। এই তিন সেক্টরের মধ্যে পোলট্রিশিল্প এগিয়ে আছে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব সম্প্রতি অনেক ক্ষেত্রেই পড়ছে। হুমকিতে পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকা। তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়তি এ তাপমাত্রা পোলট্রি খাতের জন্য সুখকর নয়।

আরও পড়ুন >> ব্যাংকের চড়া সুদে পিষ্ট পোলট্রিশিল্প

গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার প্রভাব সম্পর্কে আমরা কম-বেশি জানি। এ প্রতিক্রিয়ার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, বাড়ছে বরফগলার পরিমাণও। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপকূলবর্তী ও নিম্নাঞ্চল বা সাগরের দ্বীপাঞ্চলগুলো তলিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে পৃথিবী থেকে ৭৬ প্রজাতির প্রাণী ও কয়েক হাজার রকমের গাছপালা বিলুপ্তি হচ্ছে। বহু জমি মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। প্রতি বছর কলকারখানা ও যানবাহন থেকে ২০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়ে বাতাসে জমা হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সুন্দর এ পৃথিবী সত্যিই একদিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের (কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি) নির্গমনের পরিমাণ অন্যান্য ভারী শিল্পের চেয়ে পোলট্রি শিল্পে অনেক কম। কিন্তু এ শিল্পে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

Advertisement

এ বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে, বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ হবে উদ্বাস্তু। এমনিতেই বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ। এজন্য উদ্বাস্তু এসব মানুষের জায়গা কোথায় হবে- তা নিয়ে ভাবতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, এ বিষয়ে মানুষের সৃজনশীল চিন্তাকে আরও বিকশিত করা।

তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ে জীববৈচিত্র্যে। নষ্ট হয় কৃষি ও শষ্যক্ষেত। নানা ধরনের অসুবিধায় পড়ে পশু-পাখি, হাঁস-মুরগি। এ হিসাবে পোলট্রিশিল্পে প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।’

পোলট্রিশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকির শীর্ষে থাকা দেশ, সেহেতু এর ফলে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এ কারণে পোলট্রি খাতের প্রতি সরকারের বিশেষ নজর দেয়া উচিত। নিরাপদ ও প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প হিসাবে গড়ে তোলার পাশাপাশি এ শিল্পের জৈবনিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা জরুরি।

তারা জানান, গ্রিন হাউজ গ্যাসের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড, যা উৎপন্ন হয় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নাইট্রাস অক্সাইড ও মিথেন নির্গত হয়। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠনেই এ জ্বালানির ব্যবহার বেশি। সে হিসাবে পোলট্রিশিল্পে এ ধরনের গ্যাসের নিঃসরণের পরিমাণ কম। এ কারণে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এ খাতে সরকারের অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের সভাপতি মসিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের বড় বড় বেশ কয়েকটি পোলট্রি কোম্পানি তাদের খামারের বর্জ্য নিজেদের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করছে। গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রেখে পরিবেশগত উন্নয়নে তারা অবদান রাখছে।’

‘তবে বর্তমান পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাবে এ শিল্পে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পোলট্রিশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ দুষ্প্রাপ্য হতে পারে, ফিডের পুষ্টিগুণে তারতম্য দেখা দিতে পারে। এছাড়া রোগবালাই বৃদ্ধি ও বিস্তার, মিষ্টি পানির দুষ্প্রাপ্যতা মুরগির টিকে থাকা কঠিন করে তুলতে পারে। এছাড়া তাপমাত্র বৃদ্ধির ফলে মুরগির ডিম দেয়ার পরিমাণ এবং মুরগির আকারও ছোট হয়ে যেতে পারে।’

‘এসব বিবেচনায় পোলট্রি খাত সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে’ উল্লেখ করে মসিউর রহমান আরও বলেন, ‘বেকার সমস্যা সমাধানে এ খাতের অবদান তৈরি পোশাকের পরেই। পরিতাপের বিষয়, এ খাতে বিনিয়োগ করে এখন আমরা ঝুঁকির মধ্যে আছি। এর আগে বার্ড-ফ্লুর কারণে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল এ শিল্প। সেখান থেকে অনেকে আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কোনো বিপর্যয় এলে তা মোকাবেলার মতো কোনো প্রস্তুতি আমাদের নেই, সরকারেরও নেই। ফলে এ খাত নিয়ে দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়ছে।’

‘সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে এ খাতকে এগিয়ে নিতে গবেষণা কার্যক্রম বাড়ানোর পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর খাত হিসেবে এ শিল্পকে প্রতিষ্ঠিত করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে জোর দিতে হবে’- যোগ করেন তিনি।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের অধিকাংশ মানুষ। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী। জলবায়ুর এই ঝুঁকিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের ঝুঁকি মোকাবেলার বিষয়গুলো যদি না দেখা হয়- তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ তাপমাত্রা ২ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে বাড়তে পারে। এখন যেটা প্রতি বছর এক থেকে দেড় শতাংশ হারে বাড়ছে।

এতে আরও বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় কিছু এলাকা ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রভাবে অভিবাসনের চাপ পড়বে অন্যান্য এলাকায়। এছাড়া তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ১৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট জিডিপির ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জীবনযাত্রার মান বছরে ১ দশমিক ৩০ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে, ২০৫০ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়াবে ২ দশমিক ৯০ শতাংশ। একই সময়ে কার্বন নিঃসরণে তীব্রতার কারণে জীবনযাত্রার ক্ষতির পরিমাণ ২ দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৭০ শতাংশে।

পোলট্রিশিল্পে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি জীব ও প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর। কার্বন নিঃসরণের তীব্রতার কারণে জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়ছে। এটা শুধু মানুষের ক্ষেত্রে নয়, নদী-নালা, বনভূমি, পাখি ও প্রাণীকূলেও প্রভাব পড়ে।

‘আমরা দেখি, পোলট্রি মুরগিকে সবসময় অতিরিক্ত গরম ও শীত থেকে রক্ষার চেষ্টা করা হয়। এর মানে এগুলো অস্বাভাবিক তাপমাত্র সহ্য করতে পারে না। এখন যদি কার্বন নিঃসরণ কিংবা অন্য কোনো কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যায়, সেটা অবশ্যই এ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা যায়, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাবে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মূলত কৃষি খাতে এ ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে প্রাণিসম্পদ খাতে ৮৭৭ কোটি, পোলট্রিশিল্পে ২২২ কোটি এবং মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা।

পোলট্রিশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশ বিপর্যয় রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এই ক্ষতির পরিমাণ কমানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব পোলট্রিশিল্পের ক্ষতি করছে অনেকটা নীরবে। এই নীরব ক্ষতির বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারলেই মঙ্গল। শুধু এ খাত নয়, মানুষের জানমাল বাঁচাতেও পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য সরকারসহ সব শ্রেণির মানষকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন হতে হবে।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে যে পরিমাণ ডিম ও মাংসের চাহিদা আছে, তার সিংহভাগ আসছে পোলট্রি খাত থেকে। স্বাস্থ্য খাতের টেকসই উন্নয়নে এ খাতের অবদান অনেক। কারণ স্বল্প খরচে মানুষ তার শরীরের আমিষের চাহিদা ঠিকই পূরণ করতে পারছে।’

‘জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাবে সবাই ঝুঁকিতে আছে- এটা সত্য। এই সত্য উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেই পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। তিনি বসে নেই। আশা করি, অন্যান্য সমস্যার মতো পরিবেশ বিপর্যয় সংক্রান্ত সমস্যাও আমরা উতরে যাব। পোলট্রিসহ প্রাণীজসম্পদ রক্ষায় আমাদের অনেক পদক্ষেপ নেয়া আছে এবং নানা পরিকল্পনাও আছে। আগামীতে ক্ষমতায় আসলে তা বাস্তবায়ন হবে।’

এমএ/এমএআর/এমএস