একাদশ জাতীয় নির্বাচন হতেই যাচ্ছে, অন্ততঃ এ পর্যন্ত যতোটুকু আলামত দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে যে, আগামী ডিসেম্বরের শেষে বাংলাদেশে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু পক্ষ তাদের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পক্ষ হচ্ছে বাংলাদেশে অবস্থান ও কর্মরত বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার আয়োজনে একটি অনুষ্ঠানে দেওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত এবং অন্যান্য কয়েকটি অ-রাজনৈতিক সংস্থা-প্রধানের বক্তব্য।
Advertisement
তারা বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সকল অনিয়মের অবসান চান। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে ও পরে ঘটা সহিংসহতা এবং নির্বাচনকে সকল প্রকার হস্তক্ষেপ-মুক্ত রাখার ব্যাপারে জোরারোপ করেছেন। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও এখানে ছিলেন না নতুন গঠিত যুক্তফ্রন্ট বা জাতীয় ঐক্যের কেউ। তার মানে বাংলাদেশের রাজনীতির শক্তিশালী বিদেশি পক্ষটি মূলতঃ প্রধান রাজনৈতিক দল বলতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকেই বোঝাতে চাইছে, বাকিদের কথা আপাততঃ কেউ মাথায় আনছে না।
এটা এক প্রকার লক্ষণ আগামী নির্বাচনে এই তিনটি পক্ষকে নির্বাচনের মাঠে উপস্থিত রাখার ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগের। কারণ তারা জানেন যে, এই তিন পক্ষকে নির্বাচনে রাখা গেলে বাকিরা এমনিতেই আসবেন, এমনকি এই সদ্য গঠিত ‘বড় মাথার ছোট জোট’-ও। জামায়াততো নিজেদের অস্তিত্ব টেকাতে যে কেউ ডাকলেই ‘আছি’ বলে দৌড়াবে। ইতোমধ্যেই দেশের বেশ ক’টি ছোট ছোট ইসলামী দল একত্রিত হয়ে একটি জোটেরও ঘোষণা দিয়েছে, যা মাঠে থাকা বাকি ইসলামী দলগুলোকেও কাছে টানতে সক্ষম হবে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
এই যখন অবস্থা তখন কেউ কি একথা ভাবছেন যে, এ বছরের শেষ নাগাদ একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না? সাংবিধানিক ভাবে এ বছরের শেষেই এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু সাংবিধানিক ভাবে সে নির্বাচন সম্পূর্ণ সিদ্ধ এবং কেউ তা নিয়ে বিশেষ করে বিদেশিদের পক্ষ থেকে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ ঘটেনি।
Advertisement
এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিয়েছে। একমাত্র বিএনপি এবং তাদের সঙ্গী কিছু রাজনৈতিক দল বলছে তারা নির্বাচনে যাবে তবে সে জন্য তাদের কিছু শর্ত সরকারকে মানতে হবে।
প্রশ্ন হলো, সরকার যদি সেসব শর্ত না মানে তাহলে কী হবে? তাহলে কি তারা নির্বাচনে যাবে না? নাকি আবারও একটি ২০১৪-র মতো সাংবিধানিক ভাবে বৈধ নির্বাচন হতে দেবে এদেশে? কিন্তু সেরকম কোনো নির্বাচন হলে ভবিষ্যতে যে সরকারটি আসবে সেটিও কি বর্তমান সরকারের মতো পাঁচ বছর পার করতে পারবে?
এসব প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মাথায় প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে। এরই মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মিথ্যাচার করে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে জাতিসংঘের একটি সহকারী সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন। কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে নিয়োজিত লবিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হয়তো আরো অনেকের সঙ্গেই তিনি সাক্ষাৎ করেছেন এবারের ঝটিকা সফরে এবং যুক্তরাষ্ট্রে এসব বৈঠকের ফলাফল কী হলো তা তিনি দেশে ফেরার আগে জানিয়েও গিয়েছেন লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা ও দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানকে।
বোঝাই যাচ্ছে যে, এই যাত্রায় বিএনপি মহাসচিব দলটির জন্য বিশেষ কোনো ফল বয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু আগামী নির্বাচনে তার দল অংশগ্রহণ করবে কি করবে না সে বিষয়ে নিশ্চিত দিকনির্দেশনা নিয়ে তবেই তিনি দেশে ফিরেছেন। আগামি সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই বিএনপি’র নির্বাচন বিষয়ক সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হবে বা অন্ততঃ সে ধারণা পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। কিন্তু বাতাসে একথা বেশ জোরেশোরেই ভাসছে যে, বিএনপি মহাসচিব তাদের নিয়োগকৃত লবিং ফার্মের মাধ্যমে যে সব জায়গায় গিয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন তার সব জায়গা থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে পরামর্শ পেয়েছেন।
Advertisement
শুধু তাই-ই নয়, বেগম জিয়ার মুক্তি চেয়ে নির্বাচনের দিকে মনোনিবেশ করার ওপরেই এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাকে পরামর্শ দিয়েছেন বলেও এসব ‘ভাসা কথা’ থেকে জানা যায়। সবচেয়ে বড় ভাসা-কথা হলো, নির্বাচনের আগে বেগম জিয়ার মুক্তি দাবি করলে দলটি না পারবে নির্বাচনে ভালো ফল করতে না পারবে বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে, তাতে আর যাই-ই হোক বিএনপি’রও কোনো উপকার হবে না, আর বাংলাদেশেরতো হবেই না। কারণ, একথা সকলেই জানে যে, বাংলাদেশের বর্তমান দ্রুতগতির অর্থনীতি ও উন্নয়ন একটি শক্তিশালী সরকার ও বিরোধী দল তথা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক পরিবেশ দাবী করে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ কোনো ভাবেই কোনো প্রকার রাজনৈতিক সহিংসতা, অগণতান্ত্রিক পরিবেশকে জায়গা দিতে পারবে না। তাতে বাংলাদেশ অন্ততঃ কয়েক দশক পিছিয়ে যাবে, যেমনটি পিছিয়েছিল ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ফলে। ঠিক একই কারণে এখন বাংলাদেশ যদি একটি শক্তিশালী সরকার (তা যে সরকারই আসুক না কেন নির্বাচনে) এবং একটি কার্যকর বিরোধী দলকে পায় তাহলে আগামী দশ বছরে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের কাতারে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে সক্ষম হবে। আর না হলে বাংলাদেশ এক ধাক্কায় যে পতনে নেমে আসবে তা থেকে সরে দাঁড়ানো হয়তো আগামী এক দশকেও সম্ভব হবে না।
ইতোমধ্যেই বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা যেমন ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিট্যুট-এর বক্তব্য থেকেই আমরা জানতে পারছি যে, বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক ‘ট্রানজিশন পিরিয়ড’ বা মধ্যবর্তীকাল পার করছে, যেখানে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। এখন বিএনপি কি বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রায় অংশ নেবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কারণ, এখন যেখানে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে বিএনপি’র কোনো অংশগ্রহণ নেই তা যেমন সত্য নয়, তেমনি এখানে বিএনপি’র সংযুক্তিও উল্লেখযোগ্য নয়।
বরং ২০০১-২০০৮ সাল নাগাদ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত যে অবনয়ন ঘটেছে তাতে বিএনপি বরং বাংলাদেশের আজকের অবস্থানে নেতিবাচক সূচকই যোগ করেছে। কিন্তু তারপরও ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর বিরোধী দলে থেকে বিএনপি যে ভূমিকা রেখেছিল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় তার গুরুত্বও কম নয়।
বর্তমান সংসদে বিএনপি না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই সরকার একক আধিপত্য বিস্তার করে দেশ পরিচালনা করেছে। যে সন্ত্রাসের পথকে বেছে নিয়ে বিএনপি সরকারকে বাধা দিতে চেয়েছিল তা যে ভুল ছিল তা দলটি বুঝতে পেরেছে এবং সে কারণেই তারা নতুন করে কোনো সহিংস আন্দোলনে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। নিশ্চিত ভাবেই দেশের জনগণ বিএনপি’র এই অবস্থানকে ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করেছে। এবং আগামী নির্বাচনে এর প্রভাবও পড়তে বাধ্য। প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে যে, সরকার কি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়? সাংবিধানিক ভাবে একটি নির্বাচন-কালীন সরকার থাকবে নির্বাচন পর্যন্ত এবং নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে কী ভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকারের তাতে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ থাকবে না, এই দাবি করার মতো কোনো কারণ তৈরি হয়নি। কিন্তু তাতে সরকারের কী কোনো লাভ হবে?
এখানেই আমার বিশ্লেষণ বলে যে, আগামী নির্বাচনে সকল পক্ষই অংশগ্রহণ করলে সরকারের পক্ষে দৃশ্যমান হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকবে না। অদৃশ্য কোনো হস্তক্ষেপ থাকলেও জনগণের প্রখর নজরদারি দিয়ে সেটাও ঠেকানো সম্ভব হবে। কিন্তু তারপরও যদি সরকার ক্ষমতাবলে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে তাহলে নির্বাচনের পরের দিন থেকেই (এমনকি নির্বাচনের দিনই) যে চাপ সরকারের ওপর আসবে তাতে আমার মনে হয় না বেশিদিন সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে।
একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়া সরকারের সামনে এই মুহূর্তে আর কোনোই পথ খোলা নেই, একথা কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম শক্তিশালী পক্ষটি অর্থাৎ বিদেশিরা বুঝতে পেরেছে। যে কারণে তারা নির্বাচনের ব্যাপারে প্রায় শতভাগ নিশ্চিত হয়েই বিভিন্ন আয়োজনে নির্বাচন বিষয়ক কর্মশালা বা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন রোডম্যাপের কথা বলছে।
এসব বার্তা স্পষ্ট করে যে, নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরে এবং সংবিধান মোতাবেকই হবে। কিন্তু সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, নির্বাচনটি যেনো কোনো ভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। সেটি এবং কেবলমাত্র সেটি নিশ্চিত করতে পারলেই, বাংলাদেশের গণতন্ত্র যেমন একটি নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে তেমনই বাংলাদেশের রাজনীতিও একটি নতুন গতিপথে পা রাখবে।
এবং এ রকম একটি নির্বাচনে যদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হেরেও যায় তাহলেও দলটি এবং তার নেতা শেখ হাসিনা একটি ইতিহাস তৈরি করবেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমনিতেই তিনি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ইতিহাস তৈরি করেছেন, এবার একটি দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইতিহাসও তিনি তৈরি করবেন বলে আমরা আশা রাখি। রচেস্টার ১৭ সেপ্টেম্বর, সোমবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/পিআর