বিগত কয়েক দশক ধরে রাজশাহী অঞ্চলের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মান্তরের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অধিকাংশই ধর্মান্তরিত হচ্ছেন খ্রিষ্ট ধর্মে। অর্থনৈতিক, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির সুযোগসহ ৫টি কারণে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন তারা। তবে ধর্মান্তরের ফলে শিক্ষা চিকিৎসায় উন্নতি পেলেও এ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। এসব কারণে এখন তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিই এখন বিলুপ্তির পথে।
Advertisement
‘ধর্মান্তর ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন : দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার কুশদহ্ ইউনিয়নের সাঁওতালদের উপর একটি সমীক্ষা’ শীর্ষক একটি গবেষণা থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. জান্নাতুল ফেরদৌসের তত্ত্বাবধায়নে ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নরেস হাসদার করা এ সমীক্ষা গবেষণা বলছে, মোট ৬০ জন সাঁওতালের মধ্যে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে ৩৬ জন। যেখানে পূর্ব পুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হয়েছে ২৫ জন এবং জন্মসূত্রে খ্রিষ্টান ১১ জন এবং শতকরা হিসেবে এ হার যথাক্রমে ৩০.৫৬% এবং ৬৯.৪৪%।
গবেষণা বলছে, ৫টি কারণে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা তথা খ্রিষ্টান মিশনারীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নতির প্রত্যাশায় তারা খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে। দারিদ্র্যতা এবং অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে শিক্ষার সুযোগ তেমন না থাকায় যাতে মিশনারী স্কুল বা কলেজে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি হয় তাই অনেকে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে। অসুস্থকালীন উন্নত চিকিৎসা বিনামূল্যে বা নাম মাত্র মূল্যে লাভ এবং মিশনারী প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবিধা লাভের আশায় অনেকে খ্রিষ্টান হয়েছে। নিজেদের পূর্ব পুরুষের ধর্মের ভিত্তি না থাকা, ধর্মীয় স্বীকৃতি না থাকা, কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ না থাকা এবং হিন্দু ধর্মের প্রভাব বিদ্যমান থাকায় সুন্দর একটা পরিচয়ের প্রত্যাশা থেকেই তারা খ্রিষ্টান হয়েছে। মিশনারীদের সেবাপরায়ণ আদর্শে মুগ্ধ হয়ে এবং মানবিকতাপূর্ণ আচার আচরণ দেখেও তারা খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণে উৎসাহ পেয়েছে।
Advertisement
তথ্য মতে, উত্তরদাতাদের মধ্যে সর্বাধিক ব্যক্তি অর্থাৎ ৬১.১১% শতাংশ লোক কোন ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। অন্যদিকে ১৩.৮৯% আর্থ-সামাজিক উন্নতির প্রত্যাশায়, ৮.৩৩% উক্ত ধর্মের প্রতি আগ্রহের কারণে, ১৬.৬৭% অন্যান্য কারণে ধর্মন্তরিত হয়েছেন। তবে ধর্মান্তরিত মোট ৩৬ জন উত্তরদাতার মধ্যে আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন কম মানুষ। শতকরা হিসেবে এ হার আর্থিক সুবিধা পেয়েছে ৩০.৫৬% এবং আর্থিক সুবিধা পায়নি ৬৯.৪৪%।
অন্যদিকে, চিকিৎসা সুবিধা সুবিধা পেয়েছে ২৯ জন এবং পায়নি ৭ জন। শতকরা সুবিধা পায়নি ১৯.৪৪% এবং সুবিধা পেয়েছে ৮০.৫৬%। ধর্মান্তরিত মোট ৩৬ জনের মধ্যে বাবা-মায়ের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়নি ৩৪ জন এবং বঞ্চিত হয়েছে ২ জন। শতকরা হিসাবে এ হার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়নি ৯৪.৪৪% এবং বঞ্চিত হয়েছে ৫.৫৬%। ধর্মান্তরের ফলে এখন পর্যন্ত নিজ সম্প্রদায় হতে কারও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি।
তবে ধর্মান্তরের ফলে সাঁওতালদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ কমে যাচ্ছে এ সম্পর্কিত তথ্যে এখানে বিপক্ষে মত দিয়েছে ১৬.৬৭% এবং পক্ষে মত দিয়েছে ৮৩.৩৩%।
সরজমিনে ধর্মান্তরিত সাঁওতালদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে, ধর্মান্তরের কারণে তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা করতে পারছেন না। তারা নিজস্ব সংস্কৃতিটাকেও বাদ দিয়ে কিছু করতে পারছে না আবার খ্রিষ্টান সংস্কৃতিটাকে ও সম্পূর্ণরুপে আপন করতে পারছে না।
Advertisement
ধর্মান্তরিত মোট ৩৬ জন উত্তরদাতার মধ্যে ১৪ জন বিপক্ষে এবং ২২ জন পক্ষে মত দিয়েছে। শতকরা হিসেবে এ হার বিপক্ষে ৩৮.৮৯% এবং পক্ষে ৬১.১১%।
ধর্মান্তরিতরা মতামত দেন, আগে তারা উপলব্ধি করতে পারেনি যে পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক সংকটে ভুগতে হবে। ধর্মান্তরের ফলে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মোট ৬০ জন উত্তরদাতার মধ্যে শতকরা ৪৩.৩৩% মনে করছে যে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না এবং ৫৬.৬৭% মনে করছে মিশ্রণ ঘটছে।
ওই এলাকার সাঁওতালদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা জানা এবং সাঁওতালদের ধর্মান্তর হওয়ার কারণ জানা একই সঙ্গে ধর্মান্তরের ফলে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় কি ধরনের পরিবর্তন এসেছে তা অনুসন্ধান করা গবেষণাটির মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়।
সালমান শাকিল/এমএএস/আরআইপি