বিশেষ প্রতিবেদন

অপরাধ প্রমাণে ব্যর্থ রাষ্ট্রপক্ষ

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার বেশিরভাগ মামলার অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় রাষ্ট্রপক্ষ। অপরাধীদের দৃষ্ঠান্তমূলক শান্তি না হওয়ায় দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে এই ধারার অপরাধ। সঠিক তদন্তের অভাবে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও অধিকাংশ মামলা অাপস-মীমাংসার কারণে আসামিরা খালাস পেয়ে যায় বলেও অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষের।

Advertisement

মামলাগুলোর খালাসের রায়ে বিচারক উল্লেখ করেন, ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এর ৫৭ ধারার অভিযোগে এজাহার দায়ের করা হলেও রাষ্ট্রপক্ষ ওই ধারায় অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন নাই। এমতাবস্থায় আসামিদের খালাস প্রদান করা হলো।’

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৩ থেকে এ পর্যন্ত (২০১৮ সালের ২৬ জুলাই) ৪৮৯টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে শাস্তি দেয়া হয়েছে মাত্র ১৮টি মামলার আসামিকে। অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় খালাস দেওয়া হয়েছে ৮৯টি মামলার আসামিকে।

খালাস-১

Advertisement

ক্রিকেটার আরাফাত সানির সঙ্গে নাসরিন সুলতানার বিয়ে হয় ২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বর। ২০১৬ সালের ১২ জুন আরাফাত সানি দু’জনের কিছু ব্যক্তিগত এবং নাসরিনের কিছু আপত্তিকর ছবি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে পাঠান। ছবি পাঠিয়ে আরাফাত সানি তাকে হুমকি দেন। ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর আবারও তার কিছু আপত্তিকর ছবি পাঠিয়ে হুমকি দেন আরাফাত সানি।

ওই ঘটনায় নাসরিন সুলতানা বাদী হয়ে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। ২২ জানুয়ারি রাজধানীর আমিনবাজার এলাকা থেকে সানিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এই মামলায় তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়। ৫৩ দিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্ত হন সানি।

৬ এপ্রিল সানিকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ ইয়াহিয়া। ২০১৭ সালের ১২ অক্টোবর সানির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাইফুল ইসলাম। ইতোমধ্যে সানি ও নাসরিন সংসার করবেন বলে আপস করেন। নাসরিন আদালতে সানির পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন।

২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল সানির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাকে খালাস প্রদান করেন। রায়ে বিচারক বলেন, সানির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তাকে মামলার দায় থেকে খালাস প্রদান করা হলো।

Advertisement

মামলার বিষয়ে নাসরিন বলেন, আমরা সংসার করবো বলে আপস-মীমাংসা করেছি। তাই আমি তার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছি। সংসার করার জন্যইতো মামলা করেছি। সবাইতো চায় একটা সুখের সংসার করতে।

খালাস-২

সাবেক কাস্টমস বন্ড কমিশনার হাফিজুর রহমানের সঙ্গে এক নারীর আপত্তিকর ছবি যুক্ত করে তা প্রকাশের হুমকি দিয়ে দুই কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন একটি জাতীয় দৈনিকের বিজনেস এডিটর। এ ঘটনায় ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি ভাটারা থানায় ওই সাংবাদিক ও নারীকে আসামি করে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেন হাফিজুর রহমান। এ মামলায় আসামিদের জেল খাটতে হয়।

মামলার পর তা তদন্তে কোনো সত্যতা না পেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

বাদী প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দিলে আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশকে (পিবিআই) তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন। ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর পিবিআই অভিযোগপত্র দাখিল করে। অভিযোগপত্রে আসামিদের দোষ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়।

২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল। মামলার বাদী হাফিজুর রহমান একমাত্র এ মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেন। সাক্ষ্যতে তিনি বলেন, আমি এই মামলার অভিযোগকারী। কিছু লোক আমার অশ্লীল ছবি বিভিন্ন ই-মেইল আইডি হতে প্রেরণ করে। আমি ভেবেছিলাম এই কাজ এজাহারভুক্ত আসামিদের। পরে জানতে পারি গ্রেফতারকৃত আসামিরা আমার কোনো অশ্লীল ছবি প্রচার বা প্রকাশ করেনি। আমি ভুল বুঝে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করি।

জেরাতে বাদী বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।

যুক্তিতে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের পিপি উভয়েই বলেন, আরো সাক্ষী দিয়ে মামলাটি প্রমাণ করতে আগ্রহ নেই। আদেশ প্রার্থনা করছি।

২০১৮ সালের ২১ মে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল আসামিদের খালাস প্রদান করেন। রায়ে বিচারক বলেন, ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এর ৫৭ ধারার অভিযোগে এজাহার দায়ের করা হলেও রাষ্ট্রপক্ষ ওই ধারায় অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন নাই। এমতাবস্থায় আসামিদের খালাস প্রদান করা হলো।’

বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনের অধিকাংশ মামলাই বাদী ও বিবাদীরা নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে নেয়। তারা আদালতে এসে মামলার বিষয়ে কোনো সাক্ষ্য দিতে চায় না। এছাড়াও আইটি (তথ্যপ্রযুক্তি) রিপোর্ট ও ফরেনসিক রিপোর্ট ছাড়া চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এজন্য অপরাধ সংঘটিত হলেও তা প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। এই কারণে আদালত আসামিদের খালাস প্রদান করে থাকেন।

তিনি আরো বলেন, সাক্ষীরা এমনভাবে সাক্ষ্য দেন যা মিথ্যা প্রমাণ করাও সম্ভব হয় না! এছাড়া মিথ্যা মামলাকারীর কোনো শাস্তির বিধান নেই এই আইনে।

এ বিষয়ে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনটি নতুন। এ তদন্ত কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। আমরা এই বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।

তিনি আরো বলেন, এই ধরনের অপরাধ বেশিরভাগ সময় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হয়ে থাকে। গুগল, ফেসবুক ও টুইটারের কাছে অনেক সময় তথ্য চাওয়া হলেও তারা তা দেয় না। আমরা চেষ্টা করছি এই সব সমস্যার সমাধান করার।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাহেরুল ইসলাম তৌহিদ বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের মামলাগুলো তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তাদের আরো সচেতন হতে হবে। তাদের এ বিষয়ে উন্নতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও যারা মিথ্যা ও হয়রানির জন্য মামলা করে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

জেএ/এসএইচএস/আরআইপি