পদ্মা সেতু ছাড়া অন্য সব বড় প্রকল্পের অগ্রগতি তেমন নেই। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এসব প্রকল্পের ওপর বিশেষ তদারকির ব্যবস্থাও রাখা হয়।
Advertisement
সরকারের পক্ষ থেকে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে এসব বড় প্রকল্পের দৃশ্যমান অগ্রগতি মানুষের দৃষ্টিগোচরের চেষ্টা চালানো হয়। পদ্মা সেতুসহ অন্য সব প্রকল্পের কাজ শুরুও করা হয়। কিন্তু পদ্মা সেতু ছাড়া অন্য প্রকল্পগুলোর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। এসব প্রকল্পের অগ্রগতির গড়হার মাত্র ১৫ শতাংশ।
তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতদিন বিভিন্ন কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু হতে দেরি হয়েছে। অগ্রাধিকারযুক্ত বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, কাজের গতিও এসেছে। দৃশ্যমান অগ্রগতি শিগগিরই নজরে আসবে।
আরও পড়ুন >> পদ্মা সেতুতে বসলো পঞ্চম স্প্যান
Advertisement
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, মেগা প্রকল্পের বেশির ভাগেরই কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট আলট্রা সুপার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (মেট্রোরেল প্রকল্প) এবং পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। এছাড়া দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছাকাছি ঘুনধুম পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেলপথ নির্মাণ, মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে প্রকল্পেও বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, বড় প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতুর। গত মাসে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর কাজের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৫৬ শতাংশ। নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
অন্য প্রকল্পের মধ্যে মেট্রোরেলের মূল কাঠামো তৈরির কাজ চলছে। উত্তরা থেকে মিরপুরের বেশ কয়েক জায়গায় মেট্রোরেলের খুঁটির ওপর স্প্যান বসানো হয়েছে। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্প, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন >> ‘পারমাণবিক কেন্দ্রে ঝুঁকির বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা’
Advertisement
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। তবে বড় প্রকল্পের কাজের গড়হার ১৫ শতাংশ। এর বেশি নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের কাজ শুরু হতে সময় লাগায় অগ্রগতি কম হয়েছে।
এ বিষয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, ‘অগ্রাধিকার প্রকল্পের কাজে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থের যেন সংকট না হয় সেজন্য এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পর্যাপ্ত। এছাড়া বছরের প্রথম থেকেই অর্থছাড় করা হবে। ফলে এখন দ্রুত কাজ এগিয়ে যাবে। শিগগিরই এসব প্রকল্পের দৃশ্যমান বড় অগ্রগতি নজরে পড়বে।’
বড় প্রকল্পগুলোতে চলতি বছরে বরাদ্দ ও অগ্রগতি
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ফাস্ট-ট্র্যাক দশটি প্রকল্পে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৩ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প : নিজস্ব অর্থায়নে সবচেয়ে বড় প্রকল্প স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ছয় হাজার ২৬ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে প্রথম পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। পরে একাধিকবার সংশোধনের পর এখন এর নির্মাণব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকায়। গত মাস পর্যন্ত অগ্রগতি ৫৬ শতাংশ। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের পাঁচটি স্প্যান বসানো হয়েছে।
আরও পড়ুন >> রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাব সমীক্ষা সঠিকভাবে হয়নি
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প : পদ্মা সেতুর সঙ্গে রেলসংযোগ প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। গত মাসে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে চায়না কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প : বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে ঈশ্বরদীতে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রেকর্ড পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায় বাস্তবায়নে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। এটির নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে।
টাকার অঙ্কে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। গত দুই বছরে প্রকল্পটিতে খরচ হয়েছে মাত্র ছয় হাজার ৪৭ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে প্রকল্পটির জায়গা অধিগ্রহণসহ প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে।
রামপালে মৈত্রী থার্মাল বিদ্যুৎ প্রকল্প : বাগেরহাটের রামপালে মৈত্রী থার্মাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক হাজার ৪০২ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে।
মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প : কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ২০২৩ সালের মধ্যে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র চার হাজার ৯৫২ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন হার প্রায় ১৪ শতাংশ।
এছাড়া বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পেও। রাজধানীবাসীকে অসহনীয় যানজট থেকে মুক্তি দিতে দুটি অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পেও অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর একটি হলো- মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প এবং অপরটি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণকাজ।
আরও পড়ুন >> ভোগান্তির সড়কে আশার খুঁটি
মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প : এ প্রকল্পের আওতায় উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হবে। ২০১২ সালে নেয়া এ প্রকল্পের প্রথম ছয় বছরে অগ্রগতি মাত্র ১৩ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে দুই হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ প্রকল্পের জন্য তিন হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রতি ঘণ্টায় ২২ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করতে পারবেন। রাজধানীবাসীরও প্রকল্পটি নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ আছে। ২০১৯ সালে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ট্রেন চলাচল চালু হওয়ার কথা। ২০২৪ সালে এটির নির্মাণকাজ শেষ হবে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ প্রকল্প : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে রাজধানীর যানজট ৩০ ভাগ কমে আসবে। ২০২১ সালের মধ্যেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা ভোগ করবে রাজধানীবাসী।
এটি নির্মাণে ৮০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এয়ারপোর্ট থেকে চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত চার লেন বিশিষ্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটার। গাড়ি ওঠা-নামার র্যাম্পসহ এর দৈর্ঘ্য হবে মোট ৪৬ কিলোমিটার। তিনটি ধাপে এর নির্মাণ কাজ চলছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে ১৬টি এবং গাড়ি নামার জন্য ১৫টি র্যাম্প বা সংযোগ সড়ক থাকছে। আর আটটি পয়েন্টে থাকছে টোল প্লাজা।
কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্প : চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে কর্ণফুলী সড়ক টানেল নির্মাণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা।
‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ’ শীর্ষক এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর পতেঙ্গা ও দক্ষিণে আনোয়ারা এলাকায়। আট হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা (সম্ভাব্য) ব্যয়ের এ টানেলের অ্যালাইনমেন্ট হবে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে কর্ণফুলী নদীর দুই কিলোমিটার ভাটির দিকে। টানেলের প্রবেশপথ হবে নেভি কলেজের কাছে। বহির্গমন পথ হবে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের সিইউএফএল সার কারখানাসংলগ্ন ঘাট। মোট নয় হাজার ২৬৫ দশমিক ৯৭১ মিটার দৈর্ঘ্যের প্রকল্পটির মধ্যে টানেলের দৈর্ঘ্য তিন হাজার ৫ মিটার (উভয় পাশের ৪৭৭ মিটার ওপেন কাট বাদ দিয়ে)।
দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেলপথ প্রকল্প : এ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে তিন হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। এক দফা ব্যয় বৃদ্ধির পর প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা; মেয়াদ ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। তবে গত বাজেটের অন্যতম ও অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প থেকে সরকার সরে এসেছে। এবারের বাজেটে এ প্রকল্পের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি।
এমএ/এমএআর/এমআরএম/আরআইপি