ক’বছর আগে হঠাৎ করে গণমাধ্যমে যখন একটি খবর পরিবেশিত হয়েছিল যে, অচিরেই বঙ্গবন্ধুর লেখা একটি বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরো বিষয়টি নিজেই তদারক করছেন তখন দু’ধরনের অনুভূতি এবং প্রতিক্রিয়া মনের ভেতর সৃষ্টি হয়েছিল। এক. বঙ্গবন্ধু কি তাজউদ্দীন আহমদের মতো কোনো ডায়রি লিখেছেন? তাঁর জীবদ্দশায় তা তেমন কিছু শোনা যায়নি। বরং গাফ্ফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে কিছু অনুলিখন নিয়েছিলেন বলে শোনা যেতো-তা নিয়ে কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে কিনা-এ রকম একটি কৌতূহল মনে মনে পুষছিলাম। দুই. শেখ হাসিনা তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কয়েক বারই বলেছেন যে, আমেরিকার জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বাঙালি অধ্যাপক ড. এনায়েতুর রহিমের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা ও ডায়রি নিয়ে একটি কাজ করছেন। এতে প্রতীক্ষার আগ্রহ থাকলেও বিশেষ কোনো বিস্ময় সৃষ্টির মতো সংবাদ না হওয়ায় কেউ বুঝতেই পারেনি যে আমাদের জন্যে অদূর ভবিষ্যতে কী ধরনের মহাবিস্ময় অপেক্ষা করেছিল।কিন্তু ২০১২ সালে যেদিন ঘটা করে প্রচারিত হলো, বঙ্গবন্ধুর লেখা একটি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশিত হলো সেদিন অাক্ষরিক অর্থেই আমরা অভিভূত হয়েছি। উক্ত গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের ছবি টিভি পর্দায় দেখানো হলে তাতে গ্রন্থের ওপর পৃষ্ঠায় সুদর্শন তরুণ মুজিবের স্যুট-টাই পরা একটি ছবি দেখে অভিভূত হয়েছি, বইটি সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে উঠি। কেননা, বঙ্গবন্ধুর লেখা কোনো পাণ্ডুলিপি এতো বছর পর উদ্ধার হয়েছে তেমন কোনো সংবাদই মিডিয়ায় এসেছে বলে মনে পড়ে না, সে রকম সংবাদ হলে অন্তত গবেষক, পাঠক মহলে বড় ধরনের তোলপাড় পড়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেটি না হওয়ার কারণ বোধগম্য ছিল না। এমনিতেই আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের মধ্যে বেশ ক’জন পোড় খাওয়া নেতা ছিলেন। তবে অল্প ক’জন বামপন্থী নেতা ছাড়া কেউ নিজেদের বা দেশের রাজনীতি নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি করেন নি। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কেও এক সময় বলা হতো, তিনি আমাদের বড় নেতা, কিন্তু তিনিও কিছু লিখে যাননি। এ ধরনের চূড়ান্ত কথা অনেকে বলতেন, নিজেদের লেখালেখিতেও তা উল্লেখ করতেন। বঙ্গবন্ধু জেলে বা জেলের বাইরে বসে কোনো কিছু লিখে গেছেন তেমন কোনো কথা কাউকে উচ্চারণ করতেই শুনিনি। ফলে বঙ্গবন্ধুর কোনো আত্মজীবনীমূলক লেখার কথা কল্পনাতে না আসাই স্বাভাবিক ছিল। অধিকন্তু বঙ্গবন্ধুর তেমন কোনো লেখা যদি থাকতো তা হলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেটি প্রকাশে বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের কারো না কারো আগ্রহ নেওয়ার কথা স্বাভাবিকভাবেই থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তেমন কিছুও ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত ঘটে নি। ফলে বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনে লেখা কোনো পাণ্ডুলিপির প্রকাশ তো স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটার কথা ছিল। তেমন কিছু না ঘটায় বিষয়টি কল্পনার বাইরে ছিল। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ১৯৭২-৭৫ সালের ঘটনাবলি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর লেখা কোনো পাণ্ডুলিপি থাকলে সেটি ১৯৭৫-এ ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের পর হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তারপরও তেমন কোনো পাণ্ডুলিপির প্রাপ্তি ঘটলে সেটিওতো তোলপাড় ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা হয়েই আবির্ভূত হওয়ার পর্যায়ে ছিল। কিন্তু তেমন কিছু না ঘটায় বঙ্গবন্ধুর লেখা কোনো পাণ্ডুলিপি থাকতে পারে এমনটি অনেকটাই সাধারণভাবে বিশ্বাসের বাইরে চলে গিয়েছিল। তবে আমরা যারা ইতিহাসের ছাত্র তাদের অভিজ্ঞতা কিছুটা ভিন্ন কথাও বলে। পৃথিবীতে অনেক দলিলপত্র, পাণ্ডুলিপি শত শত বছর লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেছে, এক হাত থেকে অন্য হাত হয়ে একদিন আলোর মুখ দেখেছে। বঙ্গবন্ধুর লেখা পাণ্ডুলিপিটি গত শতকের ষাটের দশকের শেষ দিকে জেলে বন্দি অবস্থায় অনেকটা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের পীড়াপীড়ি ও সহযোগিতায় লেখা। তবে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলি লেখার পরই তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি লাভ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধুর লেখায় ছেদ পড়েছে। এরপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া, পরবর্তীকালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার, ৩২ নম্বর ধানমন্ডি ত্যাগ করে বেগম মুজিবসহ পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র চলে যাওয়া, বিজয়ের পর ফিরে আসা...।সব কিছু মিলিয়ে পাণ্ডুলিপির ৪টি খাতার কথা হয়তো অনেকের জানার বাইরে চলে যায়। এরপর যারা বঙ্গবন্ধুর এমন পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে অবগত ছিলেন তাদের প্রায় সকলেই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট নিমর্ম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ফলে বঙ্গবন্ধুর লেখার এমন অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপির কথা কারোই আর জানা না থাকারই কথা। কিন্তু রাখে আল্লাহ; মারে কে! এটি এরিমধ্যে ৩২ ধানমন্ডি থেকে বাংলার বাণী পত্রিকা কার্যালয়ে কার মাধ্যমে গেল, সেখান থেকে মাত্র ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার হস্তগত হওয়া এক মহা বিস্ময়কর ঘটনা। পাণ্ডুলিপিটি শেষ পর্যন্ত এমন একজনের হাতেই এলো, যিনি পিতার অপার ভালোবাসা, আবেগ, আর স্নেহের পরশ পেতে পাণ্ডুলিপিটি বুকে তুলে নেন, যেন আপন পিতাকেই পিতার লেখায় খুঁজে পাচ্ছিলেন, পিতার সঙ্গে কথা বলার মতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ যেন খুঁজে পেলেন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পাণ্ডুলিপিটিতে যেন পিতার কণ্ঠ ফিরে পেয়েছেন, গোটা জাতি অবশ্য পেয়েছে জনকের লিখে রাখা এমন এক মহাগ্রন্থ যা জাতীয় ইতিহাসের অসম্পূর্ণ হলেও এক অসাধারণ উপাখ্যান। এর সঙ্গে অন্য কোনো গ্রন্থের তুলনা করার সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থাকারে প্রকাশের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকের মতো আমিও দ্রুত এর একটি কপি সংগ্রহ করে পড়তে শুরু করি। প্রথমেই বলে রাখি শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর এমন গ্রন্থটি সম্পাদনা এবং প্রকাশের দায়িত্ব যাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তারা বইটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বেশ উপলদ্ধি করতে পেরেছেন। গ্রন্থটি হাতে নিতেই এর প্রতি পাঠকের পড়ার আকর্ষণ বৃদ্ধি পাওয়ার যথেষ্ট উপাদান প্রকাশিত গ্রন্থটিতে রয়েছে। ফলে বইটি দৃষ্টি নন্দন এবং পঠন আগ্রহের ষোলআনা পূরণ করার মতো হয়েছে। বইটি হাতে নিয়ে শুরুতেই চোখে পড়ে শেখ হাসিনার লেখা চমৎকার একটি ভূমিকা। এতে পাণ্ডুলিপিটি গ্রন্থের আকারে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পটভূমি অত্যন্ত আবেগঘনভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই গ্রন্থের জন্যে এমন একটি মুখবন্ধ যেমন খুবই প্রাসঙ্গিক, তেমনি অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতে পাঠককে সাহায্য করবে। এরপরই বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখা ফটোকপি দিয়ে বইটি শুরু। ষাটের দশকের শেষ দিকে কারা জীবনে বসে কীভাবে ও কেন তিনি এমন একটি লেখায় হাত দিলেন সেই বর্ণনা দিয়েই তার লেখা শুরু। এরপরই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারের প্রায় দুইশত বছরের ইতিহাস তিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। কোথাও অতিরঞ্জনের মনোভাব বঙ্গবন্ধুকে স্পর্শ করে নি। অত্যন্ত সাবলীলভাবে তার পূর্বপুরুষদের উত্থান-পতনের একটি চমৎকার বিবরণ তিনি তুলে ধরেছেন। বেশিরভাগ বাঙালি পরিবারের সদস্যই নিজেদের পরিবারের অতীত ইতিহাস খুব বেশি জানেন না। ব্যতিক্রম যাদের দেখা যায় তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু অন্যতম। তিনি পরিবারের অতীত ইতিহাসটি জেলে বসে নিজের স্মৃতি থেকে লিখতে পেরেছেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ঐতিহ্যগতভাবে শেখ বংশ শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর ছিল, সরকারি নানা চাকরি এবং দায়িত্ব পালন করায় পূর্বপুরুষদের নাম ও অবস্থান সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম কম-বেশি জানতো। তাছাড়া পরিবারটির বন্ধনও ছিল বেশ অটুট। রেণু তথা বেগম ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে তার বিয়েটি কীভাবে পারিবারিকভাবে হয়েছে, কীভাবে তিনি এই পরিবারের সদস্যের মতোই বেড়ে ওঠেন-তা নিঃসংকোচে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু। নিজের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, স্কুলে পড়া, চোখের অসুখে কিছু সময়ের জন্যে বিরতি পড়া, পনের-ষোল বছরের বয়ো সন্ধিক্ষণে দেশে স্বদেশী আন্দোলনে তিনি কীভাবে আকৃষ্ট হলেন, ইংরেজ-বিরোধী মানসিকতা কীভাবে তার মধ্যে গড়ে উঠতে শুরু করে- এর পুরো বিবরণটি যেন আপনা-আপনি লেখায় এসে গেছে। একই সঙ্গে তার শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি সাহেবের যে বিবরণ দেন তাতেই বোঝা যায় যে, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের হাতে তার তরুণ বয়সটি বেড়ে ওঠার সকল সুযোগ বঙ্গবন্ধুর পিতাই তার জন্যে করেছেন। কাজী আবদুল হামিদ গোপালগঞ্জে ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠনের মাধ্যমে গরিব ছেলেদের লেখাপড়ার জন্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহের যে ব্যবস্থা করেন তাতে তরুণ মুজিব যুক্ত হন। এসব করতে গিয়ে দুরন্তপনার কিছু কথাও অকপটে তিনি উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু ভোলেন নি তার পিতা বাড়িতে যেসব পত্রিকা তাদের পড়ার জন্যে রাখতেন সেগুলোর নাম উল্লেখ করতে। যেমন, আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাতের নাম। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর লেখা-পড়া, খেলাধুলা, সমাজ সেবা, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার উন্মেষ পরবর্তী জীবনে যেভাবে ঘটেছে সেসবের তথ্য, নাম, ঘটনা ও বিষয়ের কথা তিনি অনেকটা গল্পের মতোই ছবি আঁকতে আঁকতে লিখে গেছেন। এখানে কোথাও কিছুই গোপন করার প্রবণতা যেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, একইভাবে সাম্প্রদায়িক নানা ঘটনার মধ্যেও তরুণ এই মুজিব উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির গুরুত্বটি আপনা থেকেই যেন বুঝতে শুরু করেছেন। তবে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তরুণ শেখ মুজিবের পরিচয়, পরিচয় থেকে ঠিকানা নিয়ে যাওয়া এবং সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে মুজিবের চিঠি পাওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে উভয়ের মধ্যে যে রাজনীতির যোগসূত্র সৃষ্টি হয় তার একটি চমৎকার বিবরণ পৃষ্ঠা ১১-তে রয়েছে। কলকাতায় গিয়ে সেই সূত্রেই তরুণ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর স্নেহ লাভ করেন, রাজনীতির দীক্ষা নেওয়ার সুযোগ পান। গোপালগঞ্জের ছেলে শেখ মুজিবের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার শুরুটা এভাবেই ঘটে। ১৯৪০-৪১-এর রাজনৈতিক বাস্তবতায় মুজিবের মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে সক্রিয় হয়ে ওঠা, কলকাতায় গিয়ে বৃহত্তর পরিসরে যুক্ত হওয়া, ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হওয়া, পড়া-শোনার পাশাপাশি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া, নিজ জেলা ফরিদপুরে সংগঠন দাঁড় করানো, দলাদলি মিটমাট করে দেওয়া ইত্যাদি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে নিজের লেখায়। এ যেন সেই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাসের সহজ সরল বর্ণনা। তাতে বাদ পড়েনি ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কথাও। ১৯৪৩ সালে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম গ্রুপে তিনি যুক্ত হন। এটি ছিল বাঙালি প্রগতিশীলদের ধারা, মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অপর ধারাটির নেতৃত্ব দিতেন খাজা নাজিমুদ্দিন। এ সময়ের ইতিহাসটিও তিনি তুলে ধরেছেন বেশ চমৎকারভাবে। বোঝা যায় মুজিব অসাম্প্রদায়িক ধারার একজন মানুষ এবং রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে আগাগোড়াই বেশ সচেতন ছিলেন। রাজনীতিতে অতিমাত্রায় জড়িয়ে যাওয়ায় তার লেখা-পড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন পিতার উপদেশ তিনি কোনোদিন ভুলেন নি। এমন সরল উক্তি আমাদেরকে অভিভূত করে। একই সঙ্গে পিতাপুত্র এক সঙ্গে বসে রাজনৈতিক আন্দোলন বিষয়ে কথা বলতেন; সেই সময়ে বেশির ভাগ মানুষই রাজনীতি ও জেল জুলুমকে ভয় পেত, শেখ লুৎফর রহমান ছেলের রাজনীতি ও জেল জুলুম ভোগ করার আশঙ্কাকে মোটেও ভয় করেননি। বরং তিনি এটিকে দেশের কাজ বলে দাবি করতেন। এসব বিষয় তার লেখায় যেভাবে উঠে এসেছে তাতেই বোঝা যায় রাজনীতির মানুষ হয়ে মুজিবের বেড়ে ওঠার পরিবেশটি ছিল বেশ ইতিবাচক। চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় থেকেও মুজিব কীভাবে অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতিতে নিজের অবস্থান, অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক লড়াই একের পর এক করেছেন- তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাতার পর পাতায় উঠে এসেছে। ১৯৪৭-পূর্ব এবং উত্তর পরিস্থিতিতে বাঙালি হিন্দু-মুসলিমের দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব ইত্যাদি ঘটনার যে সব দিক স্মৃতিকথায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন তা রাজনীতির ইতিহাসকে অধিকতর বস্তুনিষ্ঠ এবং অজানা তথ্যে সমৃদ্ধ করে লেখার রসদ জুগিয়েছে। বিশেষত ১৯৪৭-উত্তর পাকিস্তানের শুরুর দিনগুলিতে মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে নতুন রাজনীতির বাস্তবতা কীভাবে বেড়ে উঠেছে, সেখানে কার, কী ভূমিকা ছিল, আওয়ামী লীগের জন্ম, মুজিবের জেলে যাওয়া, ঢাকায় মুজিবের পরিবারের অনিশ্চিত জীবন, রাজনীতিতে নানা সংকট, সেই সব সংকটকে কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে নিজের কী ভূমিকা ছিল তার বিস্তারিত বিবরণ পাতার পর পাতায় ফুটে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু অনেকটাই যেন গল্প বলার ঢং-এ পাণ্ডুলিপিতে সব বলে গেছেন। কোথাও মনে হয়নি তথ্যের বিভ্রাট ঘটছে, সব যেন অবলীলায় বলে যাচ্ছেন। ১৯৪৭ থেকে’ ৫৫ সালের প্রতিটি ঘটনা, যুক্তফ্রন্ট গঠন, নির্বাচন, নির্বাচনোত্তর ষড়যন্ত্র, হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী একইসঙ্গে রাজনীতির এসব দিকপালের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক, রাজনৈতিক মতাদর্শের মিল অমিলের বিষয়সমূহে কোনো ধরনের রাখঢাক দেওয়ার চেষ্টা বঙ্গবন্ধুর দিক থেকে লক্ষ করা যায় নি। নিজের সীমাবদ্ধতা, ভুল-ত্রুটি, অপারগতা নিঃসংকোচে তুলে ধরার ক্ষেত্রেও কোনো কাপর্ণ্য করেননি, তেমনটি লক্ষ করা যায় নি। নিজের ব্যক্তিগত জীবন, পরিবারের সদস্যদের সুখ-দুঃখ এসবই যেন একের পর এক প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, রাজনৈতিক সহকর্মীদের ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রে একই ধরনের নানা কষ্ট- কী নেই এতে। মোট ৩২৯ পৃষ্ঠার বইয়ের ২৮৮ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর শেষ লেখাটি যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কেন্দ্র করে লেখা-সেই সময়ে দেশে সৃষ্ট ঘটনাবলিতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার একটি ভেতরগত বিবরণ এতে পাওয়া গেল। এরপর হঠাৎই ছেদ পড়ে গেল। ইতিহাসের এমন গল্প সম্পর্কে বলা যায় এ যেন মজার গল্প, মজার ইতিহাস। অথচ লেখার শেষ ১৯৫৫-তে। তখন পাঠকের কেবলই মনে হতে থাকে পাণ্ডুলিপিটিতে যদি বঙ্গবন্ধু পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের পুরো ঘটনাবলি সমাপ্ত করতে পারতেন তা-হলে পূর্ব বাংলার এই সময়ের রাজনীতির ইতিহাস রচনার আরো অনেক তথ্য পাওয়া যেত, যা এখনও আমরা পাইনি। জানিনা আর কোনো দিন তা পাওয়া যাবে কিনা। তবে অসমাপ্ত এই গ্রন্থে অসাধারণ দক্ষতায় বঙ্গবন্ধু রাজনীতির যে পাঠ রেখে গেছেন তা পাঠকদের মনে পাকিস্তানপূর্ব এবং পাকিস্তানকালের গোড়ার দিকের রাজনীতির ইতিহাস জানার যে আবেদন সৃষ্টি করে গেছে-তাই একদিন ইতিহাসকে পূর্ণতা দেবে। বঙ্গবন্ধু স্বাভাবিক রাজনীতির জীবন পাননি। প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করেই তিনি অসাধারণ একজন মানুষ এবং রাজনীতির নেতা হয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখিয়ে তা বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। সবই তার অসামান্য কীর্তি। এই গ্রন্থটি অসম্পূর্ণ হলেও এটি রাজনীতির ইতিহাসের অসাধারণ দক্ষতায় লেখা ইতিহাসের আকরগ্রন্থ-যার পূর্ণতার দায়িত্ব নিতে হবে দেশের রাজনীতি সচেতন মহলকে। এইচআর/পিআর
Advertisement