দেশ থেকে অনেক দূরে বসে সাংবাদিক আর ডাক্তারদের ঝগড়াঝাটি দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। সাংবাদিকরা ডাক্তারদের বলছেন কসাই, ডাক্তাররা সাংবাদিকদের বলছেন মূর্খ। এমন ভাব, পারলে এক পেশার মানুষ, আরেক পেশার মানুষদের বিলীন করে দেয়। কী দুর্ভাগ্যজনক। অথচ একবার ভাবুন সাংবাদিকবিহীন দেশ যেমন অকল্পনীয়, ডাক্তার ছাড়াও তো আমাদের চলবে না।
Advertisement
আমি প্রায় তিন দশক ধরে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত। তাই আমি সাংবাদিকদের ভেতর-বাহির, আলো-অন্ধকার সবই জানি। তেমনি অনেক ডাক্তারের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবাদে তাদের আলো-অন্ধকার, সুখ-দুঃখের গল্পও অনেক জানি। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মামুন মোর্শেদ আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন 'ডাক্তারবান্ধব সাংবাদিক' বলে। আমি আপত্তি জানাই। আমি নিজেকে দাবি করি ন্যায়বান্ধব মানুষ হিসেবে।
সবসময় হয়তো পারি না। তাছাড়া ন্যায় বিষয়টাও কখনো কখনো আপেক্ষিক। আমার কাছে যেটা ন্যায়, আপনার কাছে সেটা ন্যায় নাও মনে হতে পারে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই নীতি মেনে চলার চেষ্টা করি। বিএনপি ভুল করলে বলতে বাধে না, আওয়ামী লীগ ভুল করলেও চুপ করে থাকি না। আমার বিবেকে যেটা ন্যায় মনে করে সেটাই বলার চেষ্টা করি। সাংবাদিকরা ভুল করলেও বলি, ডাক্তাররা ভুল করলেও বলি।
শুরুতে বলে নিচ্ছি, ডাক্তারদের প্রতি আমার সমবেদনাটা একটু বেশি। একাডেমিক বিবেচনায় ডাক্তাররা অবশ্যই মেধাবী। কঠিন পরীক্ষা দিয়ে তাদের ডাক্তারী পড়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। তবে ইদানীং বাপের টাকা থাকলেই অনেক প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পড়া যায়। দেশের অনেক প্রাইভেট মেডিকেলে ভালো শিক্ষক নেই, ইন্টার্নি করার জন্য পর্যাপ্ত রোগী নেই।
Advertisement
৫/৭ বছর পর বাপের টাকায় হওয়া এমন অনেক সার্টিফিকেটধারী ভুয়া ডাক্তারে দেশ ভরে যাবে। তখন কী অবস্থা হবে, তা নিয়ে আমি এখনই শঙ্কিত। আপনি যদি ভেবে থাকেন নামের আগে 'ডাক্তার' থাকলেই তিনি সকাল-বিকাল চেম্বার করবেন, চেম্বারের সামনে রোগীর ভীড় থাকবে, সকাল-বিকাল মানুষের পেট কাটবেন আর পকেট কাটবেন, অঢেল টাকা চলে আসবে; তাহলে ভুল। এমবিবিএস পাস করা অনেক ডাক্তারকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।
মাস্টার্স পাস করেই অন্য অনেকে ক্যারিয়ার শুরু করেন। কিন্তু এমবিবিএস পাশ করার পর আসলে ডাক্তারদের পড়াশোনা শুরু হয়। আমাদের অনেক বন্ধুকে দেখি, এখনও পড়ছেন। আরো ডিগ্রি চাই। ডিগ্রি পেলেই শেষ নয়, ভালো ডাক্তার হতে হলে তাকে প্রতিনিয়ত আপডেট থাকতে হয়। এতকিছুর পর যখন কিছুটা পসার হয়, তখন জীবনের সূর্য অস্তপাটে। আমার আরেক ডাক্তার বন্ধু মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল কদিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছেন, গত সপ্তাহে হয়েছেন হেপাটলজি বিভাগের চেয়ারম্যান। তাকে নিশ্চয়ই সকাল ৯টার মধ্যে অফিসে যেতে হয়, রাত দুইটা পর্যন্ত রোগী দেখতে হয়। এরমধ্যে নির্মূল কমিটি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে মাঠে থাকেন, আবার নিয়মিত লেখালেখিও করেন, গবেষণায় পেয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। আমার তাকে মানুষ মনে হয় না, জিন মনে হয়। ২৪ ঘণ্টায় এত কাজ কোনো মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
আসলেই ডাক্তারদের মানুষ মনে হয় না, জিন বা ফেরেশতা মনে হয়। আমরা অসুস্থ হয়ে ডাক্তারদের কাছে গিয়ে বলি, ডাক্তার সাব, আমাকে বাঁচান। ওপরে আল্লাহ, নিচে আপনি। ডাক্তাররা নিশ্চয়ই চেষ্টা করেন। তারপরও রোগী মারা যায়। ভুল চিকিৎসায় যেমন রোগী মারা যায়, তেমনি সঠিক চিকিৎসায়ও মারা যেতে পারে। কিন্তু কেউ মারা গেলেই, সেটা সঠিক চিকিৎসায় হোক আর ভুল, মৃতের স্বজনরা ক্ষুব্ধ হয়। এখন কেউ মারা গেলেই যদি ডাক্তারদের মারধোর করা হয়, গ্রেপ্তার করা হয়, হাসপাতাল ভাঙচুর করা হয়; তাহলে তো ডাক্তাররা ভয়ে আর কাউকে চিকিৎসা দেবেন না। অবশ্যই তাদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা লাগবে। কিন্তু তার মানে তো তারা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তারা যা ইচ্ছা তাই করবেন, ভুল করবেন, অবহেলা করবেন; আর কিছু বললেই আপনারা সংগঠিত হয়ে মাস্তানি করবেন, এটা চলতে পারে না।
আমি মানছি, চিকিৎসাটা ভুল না সঠিক, সেটা যাচাইয়ের মত দক্ষতা সাংবাদিকদের নেই। কিন্তু যাদের আছে, তারা কি সেটা করছেন? বিএমডিসি এখন পর্যন্ত ভুল চিকিৎসার বা অবহেলার জন্য কয়জন ডাক্তারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে? বিএমএ চাইলে ডাক্তারদের পেশাগত মর্যাদা বাড়াতে অনেককিছু করতে পারতো। কিন্তু ভোট হারানোর ভয়ে কেউ কিছু করে না। তাহলে কি ডাক্তাররা নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ভোগ করতেই থাকবে? কেউ কিছু বললেই অনৈতিক ধর্মঘট ডাকবে? এটা তো স্রেফ মাস্তানি, ব্ল্যাকমেইল।
Advertisement
ইদানীং ঘন ঘন ডাক্তারদের সাথে সাংবাদিকদের লেগে যাচ্ছে। কোনো লেখা ডাক্তারদের বিরুদ্ধে গেলেই তারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগেন। সাংবাদিকদের কাজই হলো কোথাও কোনো অনিয়ম হলে যাচাই করে তা প্রকাশ করা। আমি মানছি, হাজার হাজার টিভি-পত্রিকা-রেডিও আর অনলাইনে সবসময় এথিক্স মেনে সংবাদ প্রকাশ করা হয় না। কিন্তু কিছু লিখলেই ঝাঁপিয়ে পড়া কোনো কাজের কথা নয়। এবিএম আব্দুল্লাহর মত সর্বজনশ্রদ্ধেয় ডাক্তারের বিরুদ্ধে যখন ভুল চিকিৎসার অভিযোগে মামলা হয়েছিল, তখন কিন্তু সাংবাদিকরা তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সব সাংবাদিক যেমন ভালো নয়, তেমনি সব ডাক্তারও তো ভালো নয়। এই কথাটাই ডাক্তাররা মানতে চান না।
এটা ঠিক বাংলাদেশে মানুষ বেশি। একজন ডাক্তারকে অনেক বেশি রোগী দেখতে হয়। ঢাকা মেডিকেলে যে পরিবেশে ডাক্তাররা চিকিৎসা দেন, তা অবিশ্বাস্য, অমানবিক। শেষ পর্যন্ত ডাক্তাররাও তো মানুষ। অনিচ্ছাকৃত মানবিক ভুল তাদেরও হতে পারে। সেই ভুলটা স্বীকার করলে, মেনে নিলেই, ভুল থেকে শিক্ষা নিলেই সমস্যা কমে আসবে। কিন্তু ডাক্তাররা নিজেদের ভুল মানতে চান না। একজন অমানবিক ডাক্তারের পাশেও দাঁড়িয়ে যান সবাই। অথচ এই অমানবিক, অদক্ষ ডাক্তারদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব কিন্তু ডাক্তারদেরই। নিজেদের পেশার মর্যাদা রক্ষার স্বার্থেই তাদের সেটা করা উচিত। কিন্তু করেন উল্টোটা।
একজন দুর্বৃত্ত ডাক্তারকে আগলে রাখতে গিয়ে পুরো পেশাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেন। ডাক্তার বন্ধুরা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনাদের ভুল হয় না? আপনারা কসাইখানা হয়ে ওঠা প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দেন না? আপনারা অপ্রয়োজনে রোগীকে আইসিইউতে পাঠান না? সেখানে দিনের পর দিন, এমনকি কখনো কখনো মৃত্যুর পরও তাদের আটকে রাখেন না? ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন নেন না? ঔষধ কোম্পানি থেকে অন্যায্য গিফট নেন না?
আপনারা নিজেদের প্রশ্ন করুন, কেন বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডে যায়। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজুন, আত্মসমালোচনা করুন, দুর্বৃত্ত ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আপনাদের ফেরেশতার আসনে বসিয়ে মাথায় করে রাখবো। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের কারো ক্ষোভ নেই, তবে গণমানুষের আছে। গণমানুষের ক্ষোভের কথাই গণমাধ্যমে উঠে আসে। চট্টগ্রামের সাংবাদিক রুবেল খানের কোলে তার আড়াই বছরের রাইফার লাশ কি আপনাদের কাঁদায় না?
সাংবাদিকরা রাইফার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করেছে। এইটুকু দাবি করা যাবে না? রাইফার বাবা সাংবাদিক না হয়ে ডাক্তার হলেও তো তার অকাল মৃত্যুর খবর পত্রিকায় ছাপা হতো। এমন তো নয় যে সাংবাদিকরা শুধু নিজেদের বঞ্চনার খবরই প্রকাশ করে। ডাক্তারদের ক্ষোভ, বঞ্চনার কথাও তো সাংবাদিকরাই লেখে।
সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও তো রাইফার মৃত্যুর জন্য ডাক্তার, নার্স আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করা হয়েছে। ডাক্তাররা যদি দায়ী ডাক্তারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে মানববন্ধন করতেন, তবে সেটা ন্যায্য হতো। কিন্তু হলো উল্টোটা। চট্টগ্রামের বিএমএ নেতা ফয়সাল ইকবাল হুমকি দিলেন, প্রয়োজনে তারা সাংবাদিকদের চিকিৎসা দেবেন না। কী ভয়ঙ্কর কথা। এই কথা বলার সাথে সাথে কেন তার লাইসেন্স বাতিল হলো না?
কেন আপনারা বললেন না, ঘোরতর শত্রুরও চিকিৎসা করবো না, এটা বলার সুযোগ কোনো ডাক্তারের নেই? কেন আপনারা ম্যাক্স হাসপাতালের অন্যায্য বাণিজ্যের প্রতিবাদ না করে তাদের পাশে দাঁড়ালেন। আপনারাই বলুন ম্যাক্স হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের দায় সাংবাদিকদের ওপর চাপিয়ে বিনা নোটিশে ধর্মঘট ডাকা কি ঠিক হয়েছে? আপনারা যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন, তাহলে তো আর সাংবাদিকদের মাঠে নামতে হতো না।
এ প্রসঙ্গে একদম ঠিক কথাটি বলেছেন হাইকোর্ট, 'মানুষ বিপদে পড়লে তিন পেশার লোকের কাছে যায়। এসব পেশা যদি কিছু দুর্বৃত্তের কারণে ধ্বংস হয়, তবে মানুষ বিপদে পড়বে। মেয়েটিকে (রাইফার) তো ফিরিয়ে আনা যাবে না। মানুষের ভুল হতেই পারে। ভুলটা অন্যায় নয়। কিন্তু ভুল জাস্টিফাই করার জন্য যদি ধর্মঘট ডাকা হয়, তা অন্যায়।' এই অন্যায়টা কিন্তু আপনারা বারবার করছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলেই গালাগাল করছেন, এ কেমন কথা।
হাইকোর্টও বলেছেন, ভুল তারাও করেন। করেন বলেই হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে বদলে যায়। কিন্তু ডাক্তারদের আচরণ দেখে মনে হয়, ভুল তারা করতেই পারেন না। মানছি সাংবাদিকরা মূর্খ, আপনারা মেধাবী। কিন্তু মূর্খ সাংবাদিক ভুল করলে মানুষের মান যাবে। কিন্তু মেধাবী ডাক্তার ভুল করলে মানুষের জান যাবে। আপনারা তো জেনেশুনেই এই কঠিন পেশা বেছে নিয়েছেন। আপনাদের হাতে যেহেতু মানুষের জীবন মরণ, তাই আপনাদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
হাইকোর্ট যে দুর্বৃত্তদের কথা বলেছেন, তাদের চিহ্নিত করুন। যার অবহেলায় রাইফার মত শিশুর জীবন গেছে, যে ডাক্তার নেতা সাংবাদিকদের চিকিৎসকদের না দেয়ার হুমকি দিয়েছেন, যে ডাক্তার নেতা ম্যাক্স হাসপাতালকে বাঁচাতে ধর্মঘট ডেকেছে; তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন, প্রতিবাদ করুন, প্রয়োজনে রাস্তায় নামুন; কথা দিচ্ছি সেই ন্যায্য আন্দোলনে 'মূর্খ' সাংবাদিকরা আপনাদের পাশেই থাকবে। আপনারা আমাদের প্রতিপক্ষ নন। আপনারাও আমাদের প্রতিপক্ষ মনে করবেন না, বানাবেন না। অল্পকিছু দুর্বৃত্ত ডাক্তার দিয়ে আমরা পুরো পেশাকে মূল্যায়ন করি না। তেমনি আপনারাও দুয়েকজন সাংবাদিকের ভুলকে পুঁজি করে পুরো পেশাকে মূল্যায়ন করবেন না।
১১ জুলাই, ২০১৮
এইচআর/এমএস