দুইজন এক সঙ্গে পৃথিবীতে ছিলেন বছর চারেক। তখন লেভ ইয়াসিন পঞ্চাশ অতিক্রম করেছেন, ইগোর আকিনফিভ দুধের শিশু। সময়টা আশির দশকের শেষ দিকের। ২৮ বছর পর আবার রাশিয়ানদের মুখে মুখে দুই সময়ের দুই কিংবদন্তি। অনেকেই ৩২ বছরের আকিনফিভের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছেন লেভ ইয়াসিনের প্রতিভা। গোল পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে একজন ফুটবল কীভাবে কিংবদন্তি হতে পারেন, লেভ ইয়াসিন তা দেখিয়ে গেছেন ষাটের দশকে। তারই উত্তরসূরী হিসেবে ইগোর আকিনফিভ নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রাশিয়াকে।
Advertisement
দুইজনেরই জন্ম মস্কোতে। লেভ ইয়াসিন পৃথিবীতে এসেছিলেন ১৯২৯ সালের ২২ অক্টোবর, আকিনফিভ এসেছেন ১৯৮৬ সালের ৮ এপ্রিল। মস্কোর দুই প্রজন্মের দুই গোলরক্ষকের মিলন ঘটছে এখন রাশিয়ানদের মুখে মুখে। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) চতুর্থ হয়েছিল লেভ ইয়াসিনের অসাধারণ নৈপুণ্যে। ৫২ বছর পর আরেক গোলরক্ষক আকিনফিভের নৈপুণ্যে রাশিয়া উঠেছে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। আরো ওপরে ওঠার হাতছানি এখন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়া রাশিয়ার সামনে।
ব্ল্যাক অক্টোপাস, ব্ল্যাক স্পাইডার ও ব্ল্যাক প্যান্থার-এই তিন নামের মাঝে এক সময় হারিয়ে গিয়েছিল লেভ ইয়াসিনের আসল নাম। এ উপাধিগুলোই প্রমাণ করে গোলপোস্টের নিচে কতটা ভয়ঙ্কর ছিলেন লেভ ইয়াসিন। প্রতিটি উপাধির আগে ‘ব্ল্যাক’ শব্দটি বসার কারণও ছিল। লেভ ইয়াসিনের পছন্দ ছিল কালো পোষাক। গোলপোস্টের নিচে কালো জার্সি পড়েই দাঁড়াতেন সর্বকালের সেরা এ গোলরক্ষক।
একজন ফুটবলশিল্পী মানেই সবুজ ঘাসের বুকে পায়ের তুলিতে ছবি আঁকা। বিশ্বে অসংখ্য কৃতীমান ফুটবলার ছিলেন, আছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের মেধা, পরিশ্রম ও শিল্পগুণ দিয়ে ফুটবলকে করে তোলেন আরো উপভোগ্য। লেভ ইয়াসিন ছিলেন তেমনই একজন। দায়িত্ব আর নৈপুণ্য দিয়ে তিনকাঠির মাঝের জায়গায়টাকে ইয়াসিন নিয়ে গেছেন শিল্পের পর্যায়ে। দর্শনীয় কিছু গোল করে যেমন ফুটবলে নায়ক হওয়া যায়, কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করা যায়, তেমন হওয়া যায় গোল ঠেকিয়েও।
Advertisement
একটা, পাঁচটা বা পঁচিশটা-কতগুলো পেনাল্টি ঠেকালে একজন গোলরক্ষক হিরো বনে যান? লেভ ইয়াসিনের এমন কৃতিত্বের পরিসংখ্যান তো চমকে দেয়ার মতো। ক্যারিয়ারে তিনি পেনাল্টি ঠেকিয়েছেন ১৫১টা। নায়ক হতে আর কিছু লাগে?
গোলপোস্টের নিচে দাঁড়ানো মানেই তো যুদ্ধ মোকাবেলা করা। লেভ ইয়াসিন সেটা শুরু করেছিলেন জন্মের কয়েক বছর পর থেকেই। এক কারখানা শ্রমিক দম্পত্তির ঘরে জন্ম নেয়া ইয়াসিন কষ্টেই বেড়ে উঠেছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাকে যুদ্ধে সহায়তাকল্পে তাকে জোর করে কারখানার কাজে পাঠানো হয়।
আগুন যেমন ছাঁইচাপা দিয়ে রাখা যায় না, তেমন প্রতিভাও। কারখানায় কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফুটবল নিয়ে নেমে পড়তেন ছোট্ট লেভ ইয়াসিন। গোলপোস্টের নিচে তার প্রতিভা চোখে পড়ে আলেক্সি খোমিচ নামের সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন গোলরক্ষকের। ওই সময়ের খ্যাতিমান গোলরক্ষক খোমিচ নিজের যোগ্য উত্তরসূরী বানাতে তার ক্লাবের অনুশীলনে নিয়ে যান ইয়াসিনকে। ব্যাস, বাঁক ঘুরে যায় লেভের জীবনের।
১৯৫০ সালে ডায়নামো মস্কোর যুবদলে ডাক পান ইয়াসিন। সেখানেই ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু করে, সে ক্লাবেই শেষ করেন। ক্লাবের জার্সি গায়ে তার ম্যাচ ৩২৬টি। প্রতিভার শেষ ছিল না লেভ ইয়াসিনের। কেবল ফুটবলেরই নন, তিনি আইস হকিরও গোলরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
Advertisement
লেভ ইয়াসিন সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে চার-চারটি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছেন। অধিনায়কের আর্মব্যান্ডও পড়েছেন। তার দক্ষ নেতৃত্বেই সোভিয়েত ইউনিয়ন দুইবার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছেন। ১৯৬৬ সালে চতুর্থ হওয়া দলেরও সদস্য ছিলেন তিনি। বিশ্বকাপে মোট ১২ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। এর মধ্যে চার ম্যাচে কোনো গোল হজম করেননি ইয়াসিন।
ফুটবলার হিসেবে ঘরে-বাইরে এত পুরস্কার জিতেছেন লেভ, তা বর্ণনা করলে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ ফুরাবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘অর্ডার অব লেলিন’ উপাধিতেও ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। মস্কোর ডায়নামো স্টেডিয়ামে তার ব্রোঞ্জের মূর্তিটি মনে করিয়ে দেয়, গোলপোস্টের নিচের এক ফুটবলযোদ্ধাকে।
ইগোর ভ্লাদিমিরভিচ আকিনফিভের জীবনও সংগ্রামে ভরা। ইয়াসিনের মতো তিনি ক্লাব ক্যারিয়ার এক জায়গাতেই। পিএফসি সেন্ট্রাল স্পোর্টস ক্লাব অব মস্কো আর্মির হয়ে পেশাদার ফুটবল শুরু করেছেন ১৯৯১ সালে। বয়স যখন ৪ বছর তখন তার বাবা সিএসকেএ স্পোর্টস স্কুলে পাঠিয়ে দেন।
১৬ বছর বয়সে পেনাল্টি ঠেকিয়ে এবং পোস্টের নিচে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে সবার দৃষ্টি কেড়েছিলেন-সামারার এফসি কিরিলিয়া সভেতভের বিরুদ্ধে তার দলকে ২-০ গোলে বিজয়ী করায় বড় ভূমিকা রেখে প্রথম নজর কেড়েছিলেন ঘরোয়া ফুটবলে। রাশিয়ান প্রিমিয়ার লিগে ২০১২/১৩ মৌসুমে সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছিলেন এ গোলরক্ষক।
আন্ডারডগ হিসেবে ঘরের মাঠের বিশ্বকাপ শুরু করেছিল রাশিয়া। সেই রাশিয়াই এখন সেরা ৮ দলের একটি। স্বাগতিক দর্শকরা আরো বেশি কিছু প্রত্যাশা করছেন। বিশ্বকাপ শুরুর আগে যে দেশের ৬ ভাগ মানুষও দলের কোনো জয় প্রত্যাশা করেনি, তাদের অনেকে এখন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথাও ভাবছেন।
আর স্বাগতিকদের এ প্রত্যাশার পারদ উপরে উঠিয়েছেন ৩২ বছরের ইগোর আকিনফিভ। দ্বিতীয় পর্বে যার অসাধারণ নৈপুণ্যে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে তারা। টাইব্রেকার দুটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে এখন লেভ ইয়াসিনের সঙ্গে তুলনায় চলে এসেছেন মস্কোর এ যুবক।
আরআই/এমএমআর/জেআইএম