ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন হোক- প্রতিবছরই এরকম প্রত্যাশা নিয়েই শুরু হয় রাজধানী ও বিভিন্ন শহর থেকে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা। কিন্তু কর্মস্থলে আসা আর যাওয়ার পথে প্রায়শই দুর্ঘটনায় অনেকেরই ঈদ আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। আরও তো আছে পথের দুর্ভোগ - বেহাল সড়কের ঝাঁকুনি, যানজট, ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়, লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ। তারপরও সবাইকে চলতে হয় বাহনে, যেতে হয় গন্তব্যে। কিন্তু পথ কি স্বস্তির হয়?
Advertisement
একটি দুর্ঘটনা, সারা জীবনের কান্না- এরকম স্লোগানে অনেক বছর সড়কে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন দেখা যেত বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা কি কমেছে? এ প্রশ্নে অনেকেই বলবেন, বরং বেড়েছে। আর সচেতনতার খবর কি? তার মাত্রা কি কম না বাড়তি?
এটা নিরূপণ করা দুরুহ। কারণ যখন সড়কে (হোক মহাসড়ক কিংবা আঞ্চলিক সড়ক) যানবাহন বেশি থাকে তখনও এক ধরনের বিপত্তি, আবার যখন যানবাহন কম থাকে তখনও আরেক ধরণের বিপত্তি। চলতি বছরের সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে।
সারা দেশের দুর্ঘটনার চিত্র যদি না-ও দেখি, শুধু রাজধানীর দিকে তাকালেই দেখতে পাই - সড়কে জানমাল নিয়ে চলা কতটা দুর্বিষহ। আর এসবের জন্য সংশ্লিষ্টরা দুষছেন গণপরিবহণের নৈরাজ্যকে। যত্রতত্র গাড়ি থামানো, যাত্রী উঠা-নামা করা, পথচারী পারাপারের সিগন্যাল না মানা, ওভারটেক করা-এসব তো নিয়ম-নীতির বাইরে।
Advertisement
চলতি বছরের শুধু এপ্রিলের চিত্রগুলো একটি স্মরণ করলেই দেখা যাবে- দুই বাসের চাপে হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে কলেজ ছাত্র রাজীবের মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় ছিল সারা দেশ। ৩ এপ্রিল, দুপুরের দিকে বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনে দাঁড়িয়েছিল তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। ডান হাতটি বেরিয়ে ছিলো সামান্য বাইরে। হঠাৎই পেছন থেকে অন্য একটি বাস ওভারটেক করার চেষ্টা করলে দুই বাসের সংষর্ষ হয়। এসময় দুই বাসের চাপায় রাজীবের হাত শরীর থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে।
প্রথমে ডান হাত, তারপর প্রাণটাই হারালেন। রাজীবের মৃত্যুর তিনদিনের ব্যবধানে রাজধানীতেই বাস চাপায় পা হারালেন এক নারী। কলাবাগানে নার্স মাসুদা বেগমকে পিষে মেরেছে মালবাহী ট্রাক। ২০ এপ্রিল রাতে বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় গৃহকর্মী রোজিনাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস।
বাস চাপায় রোজিনার একটি পা হাঁটুর নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কয়েকদিন হাসপাতালে থেকে রোজিনা বিদায় নেন দুনিয়া থেকে। এদিকে, রাজধানীর বাইরেও সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র কম নয়। ১৭ এপ্রিল, গোপালগঞ্জে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে দেহ থেকে হাত বিচ্ছিন্ন হলো বাস শ্রমিক হৃদয় মিনারের।
শুধু সড়কই নয়, রেলপথেও দুর্ভোগের পাশাপাশি দুর্ঘটনার তালিকা ছোট নয়। এই এপ্রিলেই (১৫ তারিখে) টঙ্গিতে ঢাকাগামী কমিউটার ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে পাঁচজন নিহত ও ২৬জন আহত হয়েছে। গাজীপুরের পুলিশ সুপার বলেছেন, সিগন্যালজনিত ভুলেই এ দুর্ঘটনা।
Advertisement
রেল বা রেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে-এর খতিয়ানও কম নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে রোজ যত লোক প্রাণ হারান বা জখম হন, সেই পরিসংখ্যান শিউরে ওঠার মতো।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এআরআই-এর হিসাবে গত দশ বছরে বাংলাদেশে ২৯ হাজার ৪৩২টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ২৬ হাজার ৬৮৬ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৫৪৮ জন। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্ঘটনার মূল কারণগুলো কী এবং সমস্যাগুলোই বা ঠিক কোথায়?
সড়ক দুর্ঘটনায় চালকের যেমন ভুল আছে, তেমনি বিআরটিএ-র ভুল আছে, যারা সড়ক নির্মাণ করেন তাদের গাফিলতি ও ভুল আছে এবং এখানে যারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে তাদেরও ভুল আছে। মালিকেরও ভুল আছে। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু গাফিলতির জন্য দুর্ঘটনা ঘটে।
তবে এর মধ্যে চালকদের ভেতর যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা এটা কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে পেয়েছেন এ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।" তবে যে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দায়ে চালককে দেয়া সাজার প্রতিবাদে শ্রমিকরা পরিবহন ধর্মঘট ডাকে, সে দেশে দুর্ঘটনা রোধ করা কি সহজ কাজ!
দুর্ঘটনা, শুধু একটি মানুষের মৃত্যু বা আহতের ঘটনাতেই শেষ হয় না। এর জের টানতে হয় পুরো পরিবারকে বছরের পর বছর ধরে। এসব দুর্ঘটনায় দু'একটি শাস্তি যে হয় না, তা নয়। তবে পরিচিত মুখ বা বড় কোন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে হয়তো দু'একটা শাস্তির নজির পাওয়া যায়। যেমন দেখা গেছে তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের দুর্ঘটনার মামলাটি।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে নানা ধরনের লেখায় দৃশ্যমান হয় যে, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। রাস্তায় বের হয়ে সুস্থভাবে ফিরতে পারবেন কি না এরকম একটা আতঙ্ক কাজ করছে কম-বেশি সবারই মনে। এসব নিয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে যাত্রী কল্যাণ সমিতি অভিযোগ করে, রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী। ৩১ লাখ যানবাহনের সাথে পাল্লা দিয়ে অনিবন্ধিত, ভুয়া নাম্বারধারী ও অযান্ত্রিক যান মিলে রাস্তায় চলছে প্রায় ৫০ লাখ যানবাহন। যার ৭২ শতাংশেরই ফিটনেস নেই। একই বৈঠকে মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছিলেন, দুর্ঘটনা বন্ধ করা না গেলেও কিছু কমানো গেলে, সেটাই হবে সফলতা।
ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট মহল এগিয়ে আসবে এমনটাই কাম্য সবার। সেই সাথে অশিক্ষিত চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, জনগণের অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তার অপর্যাপ্ততা, আইন ও তার যথারীতি প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয় দূর করে, দেশে সড়ক নিরাপত্তায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
লেখক : সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম