পর্ব-১>> উৎপাদন সক্ষমতা না বাড়লেও বাড়ছে ঋণ>> কমেছে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদের বিনিয়োগ>> রাইট শেয়ারের অর্থ যথা সময়ে না ব্যবহার>> ঋণ পরিশোধে হয় সম্পদ বিক্রি অথবা নতুন ঋণ
Advertisement
ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা বলে রাইট শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করলেও তার সিংহভাগই নির্ধারিত সময়ে ব্যবহার করতে পারেনি জিপিএইচ ইস্পাত। রাইটের অর্থ অব্যবহৃত থাকলেও কোম্পানিটি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। আবার নিরীক্ষিত আর্থিক তথ্য দিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করতে হলেও কোম্পানিটি বার্ষিক প্রতিবেদনে অনিরীক্ষিত তথ্য দিয়েছে।
জিপিএইচ ইস্পাতের এসব তথ্য নিয়ে জাগো নিউজ’র দুই পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ থাকছে প্রথমটি।
ঋণ পরিশোধের কথা বলে জিপিএইচ ইস্পাত পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করলেও তালিকাভুক্তির পর কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ। ধারাবাহিকভাবে ঋণের পরিমাণ বেড়ে এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে কোম্পানিটি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাই হারিয়েছে। অপরদিকে ঋণের পাল্লা দিন দিন ভারী হলেও কোম্পানিটির উৎপাদন ক্ষমতা বিগত কয়েক বছর ধরে একই জায়গায় স্থির রয়েছে।
Advertisement
উৎপাদন ক্ষমতা না বাড়ার পরও ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে অস্বাভাবিক দেখছেন বিশেষজ্ঞ ও বিনিয়োগকারীরা। তারা বলেছেন, কোম্পানিটির কার্যক্রম এবং ঋণের টাকা কোথায় ব্যবহার হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) খতিয়ে দেখা উচিত।
ঋণের চাপে সুদজনিত ব্যয়ের কবল থেকে রক্ষা পেতে ২০১২ সালে পুঁজিবাজার থেকে ৬০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে জিপিএইচ ইস্পাত। যার ৫৮ কোটি ৮০ লাখ টাকাই ঋণ পরিশোধে ব্যয় করা হয়েছে বলে জানায় কোম্পানিটি।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পূর্বে ২০১০-১১ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির ঋণ ছিল ৩১১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ শেষে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৫৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধের জন্য পুঁজিবাজারে আসলেও এখন তা আরও ৮৪২ কোটি ২০ লাখ টাকা বেড়েছে।
এদিকে কোম্পানিটির সর্বশেষ প্রকাশিত অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন (২০১৭ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত) অনুযায়ী, এক বছরের মধ্যে জিপিএইচ ইস্পাতকে ৬২৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করতে হবে। তবে আর্থিক অবস্থা বলছে, মার্চ পর্যন্ত কোম্পানিটির ২৭ কোটি ১৯ লাখ টাকার মতো ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে কোম্পানিটিকে চলতি বছরে আরও প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং ঋণ পরিশোধ করতে কোম্পানিটিকে সম্পদ বিক্রি করতে হবে অথবা নতুন করে আবার ঋণ নিতে হবে।
Advertisement
অবশ্য চলতি হিসাব বছরের নয় মাস সময়ের যে প্রতিবেদন কোম্পানিটি প্রকাশ করেছে তাতে স্থায়ী সম্পদ ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার চিত্র উঠে এসেছে। ২০১৭ সালের ৩০ জুন শেষে কোম্পানিটির প্রোপার্টি, প্ল্যান্ট ও ইকুইপমেন্ট ছিল ১৬৪ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকার। যা চলতি বছরের ৩১ মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে ১৬২ কোটি ১৬ লাখ ১১ হাজার টাকা।
একই সঙ্গে কমেছে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদের বিনিয়োগ। ২০১৭ সালের ৩০ জুন কোম্পানিটির দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ ছিল ৩৬ কোটি ৪১ লাখ ৮১ হাজার টাকা, যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ কোটি চার লাখ ৮৭ হাজার টাকায়। ২০১৭ সালের ৩০ জুন শেষে থাকা ২৪৪ কোটি ৩৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকার স্বল্পমেয়াদের বিনিয়োগ চলতি বছরের মার্চ শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ১৮৬ কোটি এক লাখ ২৪ হাজার টাকায়।
স্থায়ী সম্পদ ও বিনিয়োগ কমলেও কোম্পানিটির দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদের ঋণের পাল্লা ভারী হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে জিপিএইচ ইস্পাতের দীর্ঘমেয়াদে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫২১ কোটি ১৭ লাখ ১৮ হাজার টাকা। যা ২০১৭ সালের জুন শেষে ছিল ১৭২ কোটি ৯ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ নয় মাসের ব্যবধানে দীর্ঘমেয়াদের ঋণ বেড়েছে তিনগুণের বেশি। অপরদিকে ২০১৭ সালের ৩০ জুন শেষে থাকা ৪৯৭ কোটি ১৪ লাখ টাকার স্বল্পমেয়াদের ঋণ চলতি বছরের মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে ৬১০ কোটি ৮৭ লাখ টাকায়। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদের ঋণের কারেন্ট পোরশন হিসাবে ১০ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং ফাইন্যান্স লিজের কারেন্ট পোরশন হিসাবে আরও দুই কোটি ৪৭ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে।
এদিকে ঋণের পাল্লা ভারী হলেও কোম্পানিটির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ছে না। ২০১১-১২ হিসাব বছরে জিপিএইচ ইস্পাতের এমএস রড উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল এক লাখ ২০ হাজার টন। ২০১৬-১৭ হিসাব বছরেও এমএস রড উৎপাদনের ক্ষমতা সেই এক লাখ ২০ হাজার টনে সীমাবদ্ধ রয়েছে। অপরদিকে এমএস ব্লেড উপাদন ক্ষমতা ২০১২-১৩ হিসাব বছরে ছিল এক লাখ ৬৮ হাজার টন। ২০১৬-১৭ হিসাব বছরেও এমএস ব্লেড উৎপাদন ক্ষমতা এক লাখ ৬৮ হাজার টনে সীমাবদ্ধ রয়েছে।
উৎপাদন সক্ষমতা একই স্থানে সীমাবদ্ধ থাকলেও ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত চার বছরে কোম্পানিটির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদ মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩৯৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ঋণ ছিল ২৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। যা বেড়ে ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে দাঁড়ায় ৬৮৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
কোম্পানিটির ঋণের পাল্লা প্রতি বছরই আগের বছরের তুলনায় বেড়ে এ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৩-১৪ বছরে কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৩৫ কোটি ৩৪ লাখ। পরের হিসাব বছর ২০১৪-১৫-এ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫৪ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। এরপর ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
জিপিএইচ ইস্পাতের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে কোনো বছরই কোম্পানিটি ওই বছরে যে ঋণ ছিল তা পরিশোধ করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে প্রতি বছরই ঋণের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো বছর দীর্ঘমেয়াদে আবার কোনো বছর স্বল্পমেয়াদের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
জিপিএইচ ইস্পাত ২০০৮ সালে ব্যবসা শুরু করে। চার বছরের মাথায় এসে ২০১২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এ সময়ে কোম্পানিটি ব্যবসায়িক সাফল্যে ৩০ টাকা (প্রিমিয়াম ২০ টাকা) দরে শেয়ার ইস্যু করে ৬০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। কিন্তু কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে আসার চার বছর পর ১৪ টাকা দরে ১৮ কোটি ৭১ লাখ ১০ হাজার রাইট শেয়ার ইস্যু করে ২৬১ কোটি ৯৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে।
ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে রাইট শেয়ার ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করলেও কোম্পানিটি সেই অর্থ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যবহার করতে পারেনি। অবশ্য রাইটের অর্থ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যবহারে ব্যর্থ হয়ে ইজিএম’র মাধ্যমে এক বছর সময় বাড়িয়ে নিয়েছে কোম্পানিটি।
এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের কথা বলে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ তোলার পর কেন ঋণ আরও বাড়ছে তা বিএসসির খতিয়ে দেখা উচিত। একদিকে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, অন্যদিকে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ছে না- এটা কিছুতেই যুক্তিসঙ্গত নয়। কোম্পানি ঋণের টাকা কোথায় ব্যবহার করছে তা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে খতিয়ে দেখতে হবে।’
বিএসইসির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কোম্পানি ঋণের পরিমাণ বাড়াতে পারে। তবে ঋণের পরিমাণ বাড়ার পরও যদি উৎপাদন সক্ষমতা না বাড়ে, সে ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।’
বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘জিপিএইচ ইস্পাতের এসব কার্যক্রম বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। এমন প্রতারণার মাধ্যমে পরিচালকরা কোম্পানি থেকে টাকা উঠিয়ে নিয়ে যান। আমাদের দাবি, এ ধরনের প্রতারণা বন্ধ হোক। এজন্য বিএসইসিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সার্বিক বিষয়ে জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি বাইরে আছি। এসব বিষয়ে আমাদের কোম্পানি সচিব আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।’
জিপিএইচ ইস্পাতের কোম্পানি সচিব আবু বক্কর সিদ্দিক ধারাবাহিকভাবে ঋণ বাড়ার কারণ হিসাবে মোবাইলে জাগো নিউজকে বলেন, ‘ট্রানজেকশন বাড়লে লোন তো বাড়বেই। বাংলাদেশের ম্যাক্সিমাম ব্যবসা চলে ব্যাংকের ঋণে। নিজেদের ইক্যুটি আছে তারপরও…। আমাদের অনেকগুলো পার্টস (যন্ত্রপাতি) আমদানি করা। কস্ট (ব্যয়) যখন বাড়বে ঋণ তখন বাড়বেই।’
‘আমাদের নতুন প্রজেক্ট থেকে যখন রেভিনিউ আসবে তখন লোন অনেক কমে যাবে’- যোগ করেন তিনি।
এমএএস/এমএমজেড/এমএআর/জেআইএম