চকমল সাহেব অফিসে ঢুকতেই মিজ বৈশাখি সামনে এসে দাঁড়াল। মিজ বৈশাখির চলাফেরায় ঝড়-ঝড় একটা ভাব আছে। চকমল সাহেব মনে করেন, এ মহিলার নাম বৈশাখি না হয়ে কালবৈশাখি হওয়া উচিত ছিল। লোকজন তাহলে নাম শুনেই তার গতিবেগ সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়ে যেত। মিজ বৈশাখি উত্তেজিত গলায় বলল-: স্যার, খবর শুনছেন?
Advertisement
খবর শোনার প্রতি চকমল সাহেব খুব একটা আগ্রহ বোধ করলেন না। সকাল থেকে তার দাঁতব্যথা শুরু হয়েছে। দুটো প্যারাসিটামল একসঙ্গে খাওয়ার পরও কাজ হচ্ছে না। সময় যত গড়াচ্ছে, ব্যথা তত তীব্র হচ্ছে। মিজ বৈশাখির ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, খবর না শুনিয়ে সে ছাড়বে না। চকমল সাহেব এক হাতে গাল চেপে ধরে বললেন-
: কীসের খবর?: আমাদের এক মন্ত্রী বলেছেন, দেশে কোনো দরিদ্র লোক থাকবে না! মিজ বৈশাখি এ অফিসের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর। তার বুদ্ধিসুদ্ধি সম্পর্কে চকমল সাহেব অত্যন্ত নিচু ধারণা পোষণ করেন। ধান গাছে শুধু ধান থাকে না। সঙ্গে চিটাও থাকে।
চিটা কোনো কাজের জিনিস না। দেশের মন্ত্রী-মিনিস্টারদের কথাবার্তার ৯৮ ভাগই হচ্ছে চিটা জাতীয়। চিটা নিয়ে নাচানাচি করার কোনো মানে হয় না, এটা বোঝার ক্ষমতা এ মহিলার নেই। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, মন্ত্রীর কথা শুনে তার পেটের ভাত সব চাল হয়ে গেছে। পেটভর্তি চাল নিয়ে এখন সে খুব সমস্যার মধ্যে আছে। চকমল সাহেব মিজ বৈশাখির দিকে তেরছা চোখে তাকিয়ে বললেন- : দেশে কোনো দরিদ্র লোক থাকবে না?: না। : কোথায় যাবে! ইন্ডিয়া, না পাকিস্তান?: কোথাও যাবে না স্যার। নির্মূল করা হবে। : বলেন কী! এতগুলো মানুষরে নির্মূল করে ফেলা হবে?: স্যার, আপনি বুঝতে পারছেন না! মানুষ নির্মূল করা হবে কেন? দারিদ্র্য নির্মূল করা হবে।
Advertisement
মানুষ অল্প দুঃখে কাঁদে। অধিক দুঃখে হাসে। দাঁতব্যথা উপেক্ষা করে চকমল সাহেব হা-হা করে হাসতে লাগলেন। দারিদ্র্য নির্মূল হাস্যকর একটি কথা। দারিদ্র্য নির্মূল করা যায় না, এটি হ্রাস করা যায় মাত্র। চকমল সাহেব নিজেও দারিদ্র্য হ্রাস করার কাজে নিয়োজিত। তিনি দেখেছেন, এ দেশের মানুষের দারিদ্র্য নিয়ে সেই পাকিস্তান আমল থেকে কী পরিমাণ ঢাকঢোল পেটানো হয়েছে! অনেক ডক্টর- ইঞ্জিনিয়ার, অনেক রাজনীতিবিদ- অর্থনীতিবিদ, অনেক ওঝা-বৈদ্য দারিদ্র্যকে উপজীব্য করে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। এজন্য তারা দাতাদের কাছ থেকে মূল্যবান পরামর্শ ও কাঁড়িকাঁড়ি টাকা পেয়েছেন। অনেকে অনেক রকম পুরস্কার পেয়েছেন। প্রাপ্তির তালিকায় নোবেল শান্তি পুরস্কারও রয়েছে। এত অর্থ, এত পরামর্শ ও পুরস্কারের ধাক্কা খাওয়ার পরও দারিদ্র্য এ দেশ থেকে লেজ গুটিয়ে পালায়নি। বরং নতুন নতুন রূপ ধরে আবিভর্‚ত হচ্ছে। এখন মান্যবর এক মন্ত্রী দারিদ্র্য নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন।
খুবই ভালো কথা! হাতি ঘোড়া গেল তল- খরগোস বলে কত জল! চকমল সাহেবের মনে হল, এর চেয়ে মন্ত্রী বাহাদুর যদি বলতেন- কিভাবে কোটিপতি হতে হয়, এ ফর্মুলা তার জানা আছে; এখন সেই ফর্মুলা বিতরণ করে তিনি দেশে কোটিপতির সংখ্যা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন, তাহলে সেটা একটা কাজের কথা হতো। হঠাৎ চকমল সাহেবের ভাবনার জাল ছিন্ন হল। মিজ বৈশাখি উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল-: স্যার, আমাদের এনজিও কি বন্ধ হয়ে যাবে!: কেন! বন্ধ হবে কেন?: দেশে যদি কোনো দরিদ্র লোক না থাকে, তাহলে আমরা কাজ করব কাদের নিয়ে?
চকমল সাহেব পুনরায় হা-হা টাইপের হাসি দিয়ে বললেন-: দেশে কোটিপতির সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে- এ খবর রাখেন? এনজিও বন্ধ হয়ে গেলে আমরা কোটিপতিদের বাসায় কাঁচাবাজারসহ বুয়া সাপ্লাইয়ের কাজ শুরু করব। আপনার কাজ হবে ফোনে ক্লায়েন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্ডার নেয়া। কী, পারবেন না?: অবশ্যই পারব স্যার। : ঠিক আছে। এখন যান, কাজ করুন।
আর বসে থাকা যাচ্ছে না। দাঁতব্যথার বিটলামি অসহ্য হয়ে উঠেছে। ধানমণ্ডি এলাকায় চকমল সাহেবের পরিচিত একজন দন্তচিকিৎসক আছেন। তিনি সেখানে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন, এমন সময় পিয়ন ওইদিনের পত্রিকা আর চায়ের কাপ সামনে রাখল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পত্রিকায় চোখ রাখতেই চকমল সাহেব দেখলেন- দারিদ্র্য নির্মূল সংক্রান্ত সংবাদটি খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। মন্ত্রী দেশ থেকে দারিদ্র্য নির্মূল করার জন্য ২০২৫ সালের টার্গেট বেঁধে দিয়ে বলেছেন- এ সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী ও সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলায় পরিণত করা হবে। চকমল সাহেব দাঁতে জিহ্বা লাগিয়ে চুঁ-চুঁ শব্দ করে আপন মনে বললেন- : বাপধন, সবই তো বুঝি! টার্গেট-ফার্গেট কিছু না, এইটা হইল অরও পাঁচবছর ক্ষমতায় থাকার ধান্ধা। এ রকম ধান্ধা সামনে রাইখ্যা রাজনীতির গাউস-কুতুবরা এর আগেও হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা জাতীয় কথাবার্তা কইছে। এখন আপনেও কইতেছেন- নির্মূল করেঙ্গা। গুড। ভেরি গুড।
Advertisement
চকমল সাহেব পত্রিকা রেখে ওঠে পড়লেন। এমন কেদরানিমার্কা কথাবার্তা মন্ত্রি-মিনিস্টাররা প্রায়ই বলে থাকেন। চকমল সাহেবের চোখের সামনে কচ্ছপের ছবি ভেসে উঠল। ডাঙ্গায় এসে ডিম দেয়ার পর জলের কচ্ছপ জলে চলে যায়। ডিমগুলো চিলের পেটে গেল, না শিয়ালের পেটে গেল- তার খোঁজ সে রাখে না। মন্ত্রি-মিনিস্টারাও তাদের কথাবার্তা বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দিয়েই খালাস। কথার বাস্তবায়ন ভবিষ্যতে কতটুকু হবে- তা দেখার প্রয়োজন তারা নিশ্চয়ই অনুভব করেন না।
রাস্তায় আসার পর চকমল সাহেব দেখলেন, একজন ভিক্ষুক চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চকমল সাহেব জানতে চাইলেন-: চাচা কি বর্তমানে রেস্টে আছেন?ভিক্ষুক চকমল সাহেবের কথা বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে রইল। চকমল সাহেব পুনরায় বললেন-: বলতেছি ভিক্ষা না কইরা এইখানে দাঁড়াইয়া রইছেন কীজন্য?: কাউলাকাউলি ভালা লাগে না।
এখানে আরও বেশ কয়েকজন ভিক্ষুক দণ্ডায়মান। বৃদ্ধ তাদের সঙ্গে কাউলাকাউলি মানে প্রতিযোগিতায় যেতে চাচ্ছে না। ভিক্ষার থলে ভরতে হলে তাকে অবশ্যই প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। চকমল সাহেব বললেন-: কাউলাকাউলি না করলে তো ভিক্ষা পাবেন না! : না পাইলে আর কী করবাম!: এই লাইনে কত বছর ধইরা আছেন?: বেশি দিন না। : ভিক্ষা কি আপনের পেশা, না নেশা? : কিতা কইন! নিশা অইত কেরে? পেটের দায়ে ভিক্ষা করি বাজান। : আগে কি করতেন?: আগে তো জমিজমা আছিল- চাষবাষ করতাম। : সেই জমিজমা কী হইছে?: সব গাঙের পেটে গেছে।
এ দেশের মানুষের নিঃস্ব হওয়ার পেছনে যেসব কারণ বিদ্যমান, নদীভাঙ্গন তার মধ্যে অন্যতম। ভাঙ্গনরোধসহ নদী ব্যবস্থাপনার কাজগুলো সততার সঙ্গে করা হলে অনেক মানুষ দরিদ্র হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেত। বর্তমানে বাংলাদেশে সততা দুর্লভ বস্তু হয়ে ওঠেছে। নদীতে ১ হাজার জিও ব্যাগ ফেলে বলা হয় ৪০ হাজারের কথা।
৫ হাজার সিসি ব্লক হিসাবের খাতায় ৫০ হাজার হয়ে যায়। শুধু নদ-নদী নয়, প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন না- এ কথা মন্ত্রিসভার ক’জন সদস্য বুকে হাত দিয়ে বলত পারবেন? দেশ থেকে গরিবি হঠাতে হলে মন্ত্রীদের অবশ্যই দুর্নীতি বন্ধ করার শপথ নিতে হবে। চকমল সাহেব বৃদ্ধকে বললেন-: চাচা, দাঁত কামড়াইয়া আর কয়টা বছর কষ্ট করেন। ২০২৫ সালের পর আপনের আর কোনো কষ্ট থাকবে না। এ ধরনের কথাবার্তা বৃদ্ধের কাছে নতুন। সে অবাক হয়ে তাকাতেই চকমল সাহেব বললেন-: আমাদের এক তালেবর মন্ত্রী বলেছেন- ২০২৫ সালের পর তিনি দেশে কোনো দরিদ্র লোক রাখবেন না। বৃদ্ধ আঁতকে উঠে বলল-: মাইরা ফেলবাইন নাকি!: না-না, মারবেন না! সবাইরে উনি ধনী বানাইয়া দিবেন। বৃদ্ধ ভিক্ষুক আকাশের দিকে মুখ তুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বলল- : এইতা অইল আবাইল্যা কথা...
চেম্বারে যাওয়ার পর দন্ত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চকমল সাহেবকে জানালেন, অন্তত দু’টো দাঁত তুলে ফেলতে হবে। দাঁত তোলার কথা শুনে চকমল সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। পরে তিনি ভেবে দেখলেন, এটা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। মানুষের জীবন-যৌবন সব সময়ের ফ্রেমে বাঁধা। সময়ই নির্ধারণ করে দেয়- কী থাকবে, আর কী যাবে। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করার পর চকমল সাহেবের মন হালকা হয়ে গেল। তিনি হালকা গলায় দন্ত চিকিৎসকের উদ্দেশে বললেন-: ডাক্তার সাহেব! আজ থেইক্যা আমার দন্তনির্মূল কার্যক্রম শুরু হইলে ২০২৫ সালের মধ্যে কি সব দাঁত নির্মূল হইয়া যাবে, নাকি ফাঁকে-ফোকে এক-দুইটা থাইক্যা যাবে?দন্ত চিকিৎসক চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকলেন। চকমল সাহেবের কথা তিনি বুঝতে পারছেন না...
লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক।
এইচআর/আরআইপি