খেলাধুলা

১৯৮২ : ব্রাজিলের সমান উচ্চতায় ইতালি

বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দলের সংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে করা হলো ২৪, বাড়ল প্রতিযোগিতার পরিধিও। প্রতিটি বিশ্বকাপ যেমন দর্শকদের জন্য নিয়ে আসে নিত্য নতুন নানা ঘটনার সমাহার। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপটাও ছিল প্রতিনিয়ত উত্তেজনায় ঠাসা। কিছু বিতর্কের কারণে এই বিশ্বকাপও কলঙ্কের কালিমামুক্ত হতে পারেনি। তারপরও শেষ হলো স্পেনে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ বিশ্বকাপ। শিরোপা জিতে নিল ইতালি। সমান ৩টি করে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে ব্রাজিলের সমান উচ্চতায় উঠে গেল আজ্জুরিরা। ১৯৩৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের ৪৪ বছর পর আবারও শিরোপা জিতল ইতালি।

Advertisement

১৯৬৬ সালেই লন্ডনে ফিফার কংগ্রেসে ১৯৮২ সালের স্বাগতিক হিসেবে নির্ধারিত হয় স্পেনের নাম। প্রথমবারেরমত ১৬ দল থেকে বাড়িয়ে বিশ্বকাপের দলসংখ্যা করা হয় ২৪টি। ১৯৭৪ আর ১৯৭৮ বিশ্বকাপে আধিপত্য বিস্তারকারী হল্যান্ড (নেদারল্যান্ডস) সেবার সুযোগই পেল না বিশ্বকাপে। সুইডেন, মেক্সিকোও ছিল না।

১২ বছর পর আবার ফিরে এলো ইংল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, বেলজিয়াম, সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৫৮ সালের পর ফিরলো উত্তর আয়ারল্যান্ড। আলজেরিয়া, ক্যামরেুন, হন্ডুরাস, কুয়েত এবং নিউজিল্যান্ড প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেল স্পেনে। আবার কুয়েত এবং এল সালভাদরের ওটাই ছিল প্রথম এবং শেষ বিশ্বকাপ।

১৯৮২ বিশ্বকাপে একেবারে আনকোরা একটি ফরম্যাট চালু করা হয়। অংশগ্রহণকারী ২৪টি দলকে ভাগ করা হয় ৬ গ্রুপে। প্রতি গ্রুপ থেকে পয়েন্ট কিংবা গোল গড়ে এগিয়ে থাকার ভিত্তিতে সেরা দুটি দল করে মোট ১২ দলকে তুলে আনা হয় দ্বিতীয় রাউন্ডে। এই ১২ দলকে আবার ভাগ করা হয় ৪টি গ্রুপে। প্রতি গ্রুপে ৩টি করে দল। এই রাউন্ডও অনুষ্ঠিত হয় রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতিতে। প্রতি গ্রুপ থেকে সেরা চারটি দল নিয়ে সরাসরি সেমিফাইনাল এবং এরপর ফাইনাল। ১৯৭০ বিশ্বকাপের পর ১৯৮২ বিশ্বকাপে একজন জেনুইন স্ট্রাইকারের অভাবে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে। ফ্যালকাও, জিকো, সক্রেটিস আর এদারদের নিয়ে গঠিত দলটিতে থাকার কথা ছিল স্ট্রাইকার কারেকারও। কিন্তু ইনজুরিই কাল হলো তার। সার্জিনহোকে দলে আনা হলেও তিনি ছিলেন না অন্যদের মাপের। ফল ব্যর্থতায় ভরা।

Advertisement

ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাও দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়ে হতাশ করল সমর্থকদের। এটা ছিল ম্যারাডোনার প্রথম বিশ্বকাপ; কিন্তু চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন তিনি।

প্রথম পর্বেই আলজেরিয়া অঘটন ঘটিয়ে বসে। ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথম রাউন্ড থেকেই দু’বারের চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানির বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল আলজেরিয়া; কিন্তু গ্রুপের শেষ ম্যাচেই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটায় জার্মানি আর অস্ট্রিয়া।

যে দলটি হইচই ফেলে দিয়েছিল বিশ্বকাপের শুরুতে, সেই আলজেরিয়াকেই পাতানো ম্যাচ খেলে অস্ট্রিয়া উল্টো বিদায় করে দেয় প্রথম পর্ব থেকে। দুই নম্বর গ্রুপের শেষ ম্যাচটিতে সমীকরণ দাঁড়ায়, যদি জার্মানি অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে জয় পায়, তাহলে দু’দলই এক সঙ্গে যাবে দ্বিতীয় রাউন্ডে। বিদায় নেবে আলজেরিয়া। আগের দুই ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা অস্ট্রিয়া ইচ্ছা করেই ১-০ গোলে হেরে গেলো পশ্চিম জার্মানির কাছে। সুতরাং, গ্রুপ থেকে অস্ট্রিয়া আর জার্মানিই চলে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে, বিদায় নেয় আলজেরিয়া।

গ্রুপ পর্বে এক নম্বর গ্রুপের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয় ইতালি-ক্যামেরুন। এই ম্যাচটি জিতলে ক্যামেরুনই উঠে যাবে দ্বিতীয় রাউন্ডে। বিদায় নেবে ইতালি। বড় দলের এডভান্টেজ পেয়ে যায় ইতালি। ছোট দল বলে হতাশা নিয়েই বিদায় নিতে হয় ক্যামেরুনকে। ম্যাচে অফসাইডের অজুহাতে রজার মিলার গোল বাতিল করে দেন রেফারি। যে কারণে ১-১ গোলে ড্র হয় ম্যাচটি।

Advertisement

পরে টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, মিলা অনসাইডে ছিলেন। ক্যামেরুন জিতলে গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে যেত ইতালি। অথচ, টানা তিন ম্যাচ ড্র করে শ্রেয়তর গোল ব্যবধানে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে গেলো আজ্জুরিরা। ইতালির মিডিয়া এ ঘটনার তুমুল সমালোচনা করে। ইতালির বিখ্যাত এক সাংবাদিক তিফোসি নিজের দলের সমালোচনা করেন অখেলোয়াড়সূলভ আচরণের জন্য। বিশেষ করে সেবারের ইতালি দলটি গঠন করা হয়েছি ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িত ফুটবলারদের নিয়ে।

৪ নম্বর গ্রুপে চেকোস্লোভাকিয়ার সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে আলোড়ন তোলে কুয়েত। তবে ফ্রান্সের বিপক্ষে কুয়েতের ম্যাচে রুশ রেফারি মিরোস্লাভ স্টুপার নির্লজ্জভাবে পক্ষপাতিত্ব করায় ফিফা তার স্ট্যাটাসই কেড়ে নেয় পরে। এছাড়া ১০ হাজার ডলার জরিমানাও করা হয় তার। ম্যাচ শেষ হয় ৪-১ ব্যবধানে।

ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের রবসন ২৭ সেকেন্ডে গোল করে তখনও পর্যন্ত সবচেয়ে দ্রুততম গোল করার রেকর্ড গড়েন। ম্যাচে ইংল্যান্ডের জয় ৩-১ গোলে। পরে অবশ্য ২০০২ বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে তুরস্কের হাকান সুকুর ১১ সেকেন্ডে গোল করে সবচেয়ে দ্রুততম গোল করার রেকর্ড গড়েন।

প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলতে আসা হন্ডুরাসের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করায় বাজেভাবেই শুরু হয় স্বাগতিক স্পেনের বিশ্বকাপ যাত্রা। দ্বিতীয় রাউন্ডও পার হতে পারেনি তারা। ৫ নম্বর গ্রুপে যুগোস্লাভিয়াকে পেছনে ফেলে উত্তর আয়ারল্যান্ডই চলে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে। তিন নম্বর গ্রুপে এল সালভাদরকে ১০-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় জয় তুলে নেয় হাঙ্গেরি।

এ বিশ্বকাপেই প্রথম টাইব্রেকারের প্রয়োগ হয়। সেমিফাইনালে ফ্রান্স আর পশ্চিম জার্মানির ম্যাচ ৩-৩ গোলে ড্র হওয়ার পর টাইব্রেকারে ফ্রান্স হেরে যায় ৫-৪ গোলে। ফ্রান্সের মিশেল প্লাতিনির যুগ শুরু হয়েছিল সেবার। অন্য সেমিফাইনালে পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে ইতালি।

ফাইনালে মুখোমুখি ইতালি এবং জার্মানি। সাবেক দুই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। মাদ্রিদের সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে অনুষ্ঠিত ফাইনালে জার্মানিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে তৃতীয়বারেরমত এবং নতুন ট্রফিতে প্রথমবার শিরোপা জিতে নেয় ইতালি। পাওলো রোসি, তারদেলি, অ্যালতোবেলি ইতালির হয়ে গোল তিনটি করেন। জার্মানির একমাত্র গোল করেন ব্রেইটনার। ইতালির পাওলো রোসি সর্বোচ্চ ৬টি গোল করে জিতে নেন গোল্ডেন বুটের পুরস্কার। এমনকি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও ওঠে রোসির হাতে।

আইএইচএস/এমএস