আইনি জটিলতায় আটকে গেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা তো দূরের কথা, কোনোভাবে চলছে দেশের ২০ হাজার বিদ্যালয়। যদিও প্রধান শিক্ষক পদে চলতি দায়িত্বে বসিয়ে এ সমস্যা দূর করার চেষ্টা করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এতে স্থায়ী কোনো সমাধান হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
Advertisement
মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে প্রায় ২০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্কট রয়েছে। এ কারণে সহকারী শিক্ষকদের ওই পদে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এতে শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত পাঠদান ব্যাহতসহ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
সূত্র মতে, প্রধান শিক্ষকবিহীন বিদ্যালয়ে প্রশাসনিক কাজ সাধারণত একজন সহকারী শিক্ষক চালিয়ে নিচ্ছেন। এ কারণে তাকে কর্মঘণ্টার বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে হয় প্রশাসনিক কাজে। ফলে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ব্যাহত হয়। এর মাশুল দিচ্ছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া অভিজ্ঞতা না থাকায় দাফতরিক কাজেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন ভারপ্রাপ্তরা। তাদের অভিযোগ, প্রায় প্রতি সপ্তাহে দাফতরিক কাজে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের সভায় যোগ দিতে ছোটাছুটি করতে হয়। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য সরকার থেকে কোনো পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। এ অবস্থায় অতিরিক্ত দায়িত্বকে বোঝা হিসেবে দেখছেন অনেকে। দায়িত্ব পালনে অনীহাও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।
Advertisement
অন্যদিকে, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব দেয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যালয় থেকে সহকারী শিক্ষক কমে যাচ্ছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান।
জানা গেছে, আইনি জটিলতায় ২০১১ সাল থেকে প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। প্রধান শিক্ষক পদটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ায় বিধিমোতবেক নিয়োগ ও পদোন্নতি সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীনে চলে যায়। নিয়ম অনুযায়ী, এ পদে ৩৫ শতাংশ সরাসরি নিয়োগ এবং ৬৫ শতাংশ জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দেয়ার কথা।
এদিকে নিয়োগবিধি না থাকায় ২০১১ সাল থেকে এ পদে পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। ফলে দেশের ৬৪ হাজার সরকারি বিদ্যালয়ের মধ্যে ২০ হাজারই চলছে প্রধান শিক্ষক ছাড়া। সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব হলেও আইনি জটিলতার কারণে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছে না মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে, প্রতি বছর পিএসসি আয়োজিত বিসিএস পরীক্ষার নন-ক্যাডার থেকে যে সংখ্যক প্রধান শিক্ষক নিয়োগে সুপারিশ করা হয় তা পর্যাপ্ত নয়। শুধু তাই নয়, যাদের সুপারিশ করা হচ্ছে তাদের অনেকে অন্য দফতর, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করায় তাদেরও পাওয়া যাচ্ছে না।
Advertisement
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ‘৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় নন-ক্যাডার পদে ৮৮৭ জন শিক্ষককে পিএসসি থেকে সুপারিশ করা হলেও তাদের মধ্যে মাত্র ৫৭০ জন কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেন। বাকিরা ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন, কেউবা আবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার পদে নিয়োগ পান। ফলে প্রতিনিয়ত প্রধান শিক্ষকের পদগুলো শূন্য থেকে যাচ্ছে।’
এ অবস্থায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের নির্দেশে গত ১০ মাস ধরে চলতি দায়িত্বে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেয়া হলেও বাড়তি সুবিধা না দেয়ায় পদোন্নতিপ্রাপ্তদের অনেকে এভাবে এ পদে বসতে অনীহা দেখাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, তাদের প্রধান শিক্ষক পদে চলতি দায়িত্বে বসানো হলেও কোনো বাড়তি সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। এ কারণে ভালো মানের শিক্ষকরা এ দায়িত্ব নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন, আর অযোগ্যরা চলতি দায়িত্ব পেতে নানাভাবে তদবির চালাচ্ছেন। অনেক জেলায় জ্যেষ্ঠতা নির্বাচনেও অনিয়ম হয়েছে। এ বিষয়ে একাধিক মামলা করেছেন প্রবীণ শিক্ষকরা। মামলার কারণে সেসব স্থানে চলতি দায়িত্বেও কাউকে বসানো সম্ভব হচ্ছে না।
সম্প্রতি এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শূন্যপদ পূরণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। নিয়োগ দিতে গিয়ে মামলার মুখে পড়তে হয়। প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদ পূরণের উদ্যোগ নেয়ার পর জাতীয়করণ হওয়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মামলা করেন। এ কারণে ইচ্ছা থাকলেও অসহায় হয়ে আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির আলোকে নিয়োগবিধি তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে সেটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। বিধি চূড়ান্ত হলে প্রধান শিক্ষক সঙ্কট আর থাকবে না।’
তথ্য মতে, সহকারী শিক্ষকদের করা রিটের জেরে বন্ধ ছিল প্রধান শিক্ষক নিয়োগ। গত বছর ওই রিটের নিষ্পত্তির পর বাধা কেটে যায়। তবে আরেক রিটের কারণে আটকে যায় পদোন্নতি। প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ নিয়ে সাবেক রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা একটি রিট করেন। ওই রিটের কারণে পদোন্নতির ওপর স্থগিতাদেশ দেন উচ্চ আদালত।
জানা যায়, দ্বিতীয় শ্রেণির বেশির ভাগ পদের সরকারি কর্মকর্তারা দশম গ্রেডে বেতন পান। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা পাচ্ছেন ১১তম গ্রেডে।
শিক্ষকদের দাবি, বিসিএস থেকে সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে হলে দশম গ্রেডেই দিতে হবে। কারণ, একই সঙ্গে সুপারিশ পাওয়া অন্য দফতরের প্রার্থীরাও দশম গ্রেডে বেতন পাবেন। শুধু শিক্ষকদের বেলায় তা না মানলে চরম বৈষম্য করা হবে। তবে প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেডে বেতন দিতে হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পাওয়াসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। এসব আনুষ্ঠানিকতা এখনও শেষ করতে পারেনি গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এফ এম মনজুর কাদির জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকের পদ দ্বিতীয় শ্রেণি হওয়ায় বিধিমোতাবেক পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। ফলে এ প্রক্রিয়ায় নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পিএসসির একটি বিসিএস প্রক্রিয়া শেষ করতে দুই বছর পার হচ্ছে। সেখান থেকে নন-ক্যাডারে কিছু সুপারিশ আসলেও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এ প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীকরণ করে নিয়োগ দেয়া জরুরি। বর্তমানে পদোন্নতিপ্রাপ্তদের প্রধান শিক্ষক (চলতি দায়িত্ব) পদে বসিয়ে এ সমস্যা দূর করার চেষ্টা চলছে।’
এছাড়া শিক্ষক নিয়োগে জাতীয়ভাবে একটি কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান তিনি।
এমএইচএম/এমএমজেড/এমএআর/বিএ