ভুল-শুদ্ধ, ঠিক-বেঠিকের মতো গণতন্ত্র-স্বৈরাচারও আপেক্ষিক হয়ে গেছে। বাকি ছিল বিচারিক বা আদালতের ফয়সালা করে দেওয়ার বিষয়। এবার তা-ও হলো। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের কোনো বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার না করার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনাও ভণ্ডুল করা হলো। তা-ও সরকারি প্রচারমাধ্যম বিটিভিতে। অথচ বেসরকারি গণমাধ্যমগুলো আদালতের সেই নির্দেশনা যথারীতি পালন করে চলছিলো। কিন্তু হঠাৎ দৃশ্যপট বদল। বিটিভি ছাড়াও কেউ কেউ ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় প্রচার শুরু করলো তার বক্তব্য।
Advertisement
এরমাঝে আবার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত, কারাভোগী স্বৈরাচার নামে খ্যাত এরশাদও নতুন পুলক পেলেন। তার মিডিয়া ভ্যালুও বেড়ে গেছে। গত ক’দিন তিনি যা ইচ্ছা বলছেন। সেগুলো বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করছে গণমাধ্যম। সকালে সরকারের পক্ষে, বিকালে বিপক্ষে স্থুল কথাবার্তা তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন। যার কিছু কিছু স্রেফ জোকারি, ভাড়ামি হলেও প্রচার পাচ্ছে। মানুষও বিনোদিত হচ্ছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে এক সন্ধ্যায় লন্ডন থেকে তারেক রহমানের ফোন। পরদিন সকালে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ছাত্রলীগ নেতাদের সাক্ষাৎ। বিকালে প্রধানমন্ত্রীর কোটা প্রথা বাতিলের ঘোষণা। আর সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের বিজয় মিছিল। সার্কাসকে হার মানিয়ে মহাসার্কাস। তারেক রহমান কিভাবে কোটা আন্দোলন জমালেন। সেখানে আবার ছাত্রলীগকেও দখল করে নিলেন। এ আন্দোলনে তিনি সফলও হলেন?
সুদূর লন্ডনে বসেও বাংলাদেশ নিয়ে এতো হিম্মত তার? তারেক রহমানের অডিওটিতে ছিল ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের শিক্ষক মামুন আহমেদের সাথে কথোপকথন। এটির প্রচার এক অর্থে তার প্রসারই এনে দিল। প্রচারে প্রসারের মতোই কাণ্ড। যদিও প্রচারের প্রেক্ষিতে উৎসাহের সঙ্গে বলা হয়েছে, এ কথোপকথনের মধ্যে ব্যাপক ষড়যন্ত্রের কথা। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শুনে গোটা আলাপচারিতার মধ্যে ষড়যন্ত্র চক্রান্ত আবিষ্কার করাটাও জটিল। বরং এর আগে তারেক রহমানের কোনো কোনো অডিও শুনে তাকে একরোখা এমন কি আনাড়িও মনে হয়েছে।
Advertisement
দলের সাবেক নেতা শমশের মুবিন চৌধুরীর কাথে কথোপকথনে মির্জা ফখরুলকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারিত কথাগুলো একজন রাজনীতিকের জন্য চরম অসম্মানের। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ধরে বলা শব্দ-বাক্যগুলোও মোটেই শোভনীয় ছিল না। কিন্তু অধ্যাপক মামুন আহমেদের সাথে কথোপকথনে ব্যতিক্রম। মামুনের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন পরিমিত, সীমিত। দায়িত্বশীলতার ছাপও স্পষ্ট। তাতে তারেক রহমানে ভাবমূর্তি উজ্জ্বলই করে ছাড়লো রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমসহ সরকার ও কিছু গণমাধ্যম। অনেকের মতে, কাজটি হয়েছে একেবারে মোটা মাথায়। এতে সরকারের লাভ হয়নি। বরং লোকসানের পাল্লা ভারির দিকে।
বিনা ইনভেস্টে লাভ হয়েছে তারেক রহমানেরই। ভিন্নতর আলোচনায় আসতে পেরেছেন। যদিও অডিওটি প্রচারের আয়োজনে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনে তারেক রহমানের কারসাজি রয়েছে। এই প্রচারণায় তিনি ঘটনাচক্রে সাবজেক্ট-ম্যাটার হয়ে গেছেন। বা সরকারই সেটা করে ফেলেছে।
একে প্রথম বা টেস্ট কেস বলা যায় না। বাংলার আবেগী মানুষ কখন কাকে বুকে টেনে নেয় আবার কখন কাকে জুতার মালা পরায় তার ঠিক ঠিকানা থাকে না। জুতার মালা আর ফুলের মালা কতো সমান্তরাল হয়ে গেছে দেশে? সকাল-সন্ধ্যা সময় লাগছে না। মিডিয়া এর বাইরে নয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে তা হালনাগাদেই দেখা গেল।
এক ছাত্রীকে নির্যাতন ও পায়ের রগ কাটার সংবাদে সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ নেত্রী এশাকে হল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বহিষ্কারের পর জুতারমালা। পরেই ফুলের মালা। বহিষ্কার প্রত্যাহার। কতো আপেক্ষিক সব কিছু। কখন কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক? পুরোটাই যার যার জুইত মতো।
Advertisement
সার্কাস এমন উড়ন্ত মাত্রায় গিয়েই ঠেকেছে। এশা নিজেই শিকার করেছেন নির্যাতন করার কথা। মাফও চেয়েছেন প্রকাশ্যে। একদিন না পেরুতেই উল্টো অ্যাপিসোড। তাকে নির্দোষ প্রমাণের ত্যানা প্যাঁচানি। তা প্যাঁচাতে গিয়ে কারো কোমড়ের লুঙ্গি বা প্যান্ট খুলে মাথায় প্যাঁচানোর দশা।
শেষমেষ আদালতের নির্দেশনা নিয়েও এই তামাশা করতে বিবেকে বাধেনি। তারেক রহমানের জন্য এটা পুলকের। এমন আজব সার্কাসের সুযোগ কেন নেবেন না পতিত এরশাদও? মৌসুমের সদ্ব্যবহার করে কেন হিরো হবার বাসনা জাগবে না খেলারামের ? এমনিতেই নিত্য নানা স্বাদ, মজা দিয়ে চলছেন তিনি।
বলতে বলতে খেইও হারিয়ে ফেলছেন। নতুন বচন হিসেবে জানিয়েছেন তিনিও ধর্ষিত। ধর্ষণের ব্যথায় কাঁতরানি প্রকাশ্য জনসভায়। মিডিয়ায় হট আইটেম। ধর্ষণ অবশ্যই অপরাধ। প্রচলিত আইনে এর গুরুতর শাস্তির বিধান রয়েছে। এরশাদকে ধর্ষণের অভিযোগ সত্য না মিথ্যা সেটা নির্ণয়ের দায়িত্ব কার? কে কোথায়, তাকে ধর্ষণ করেছে? খোদ প্রধানমন্ত্রীর দূত ধর্ষিত হলে তার চিকিৎসা, সেবা, শুশ্রূষা, দেখভাল বা যত্ন-আত্তির গুরু দায়িত্ব সরকারেরই।
এরপর অন্য স্বজনদের। কিন্তু সরকারি দল থেকে তার এ অভিযোগের জবাব এসেছে তিরস্কৃতভাবে। আওয়ামী লীগের যুগ্নসাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, এরশাদ বুড়ো মানুষ। বয়সের ভারে এমন আবোল তাবোল তিনি বলতেই পারেন। এরশাদ তাতে দমেননি। আজ এক কথা, কাল আরেক কথা বলেই চলছেন।
সর্বশেষ বচন ছেড়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়কে নিয়ে। তাদেরকে আর নৌকায় ভোট না দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগ হিন্দুদের ভোট নেয়। কিন্তু কিছু দেয় না। বরং নির্যাতন করে। সম্পদ-সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়। এ সরকারের হাত থেকে নাজাত পেতে হবে। লালমনিরহাটে এক জনসভায় বলেছেন- ধর্ষণ, খুন, ব্যাংক লুটের অরাজকতা মেনে যায় না।
যারা এরশাদকে চেনেন, জানেন তারা ভালো করেই বোঝেন এরশাদ আসলে সরকারের সঙ্গ ছাড়তে চান না। আরো ঘনিষ্ঠতা চান। ধর্ষণের মতো কিছু ঘটে থাকলে তিনি সেটা আরো বেশি করে হতে চান। ভাড়ামি কথাবার্তায় সরকারের আবারো ব্রোকারিতে নেমেছেন। তার কাতুকুতু কথাবার্তার নিউজ ভ্যালু না থাকলেও মিডিয়াতে বাজার দর রয়েছে। মানুষ হালকার ওপর বিনোদন পায়। এরশাদও সেটা দিতে চান। বিনিময়ে প্রাপ্তি যোগও হচ্ছে তার।
৫ জানুয়ারির বিনা ভোটের সংসদে এরশাদের এমপি রয়েছেন ৪০ জন। এরশাদ নিজে মন্ত্রী মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। এমপিদের মধ্যে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী তিনজন। ভোগে অভ্যস্ত হয়ে তারা ভোগ ছেড়ে ত্যাগে যাবেন কোন দুঃখে? সেটা প্রধানমন্ত্রীর ভালো করেই জানা।
স্ত্রী, ভাই, আতিপাতিদের নিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে এরশাদের বাকি জীবন সাঙ্গ করা নিরাপদ। নগদ লাভের। ভবিষ্যতে আরো চান। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ৭০টি আসনসহ ১০ থেকে ১২টি মন্ত্রণালয় চান। এর সঙ্গে নতুন কথা হিসেবে যোগ করেছেন রংপুরের ২২টা আসন দিলেও হবে। বিনিময়ে তিনি সরকারকে সার্ভিস দিয়েই যাবেন। সংবাদের বাজার দর যেখানে গেছে, সেখানে এসব খবর উপেক্ষার অবস্থা নেই গণমাধ্যমগুলোর।
অপ্রিয় হলেও সত্য হচ্ছে, উবারের যুগে সিএনজি চালকদের ধর্মঘট ডাকা আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সাংবাদিকদের সংবাদ বর্জন অর্থহীন। মাদার অব, ডটার অব, ব্রাদার অবের ভরা মৌসুমে চলমান এ ধারা সৎ ও তারকা রাজনীতিক মতিয়া চৌধুরীকেও কিভাবে কামরুল-হাছানদের কাতারে নামাতে পারে সেই সার্কাস শো-ও দেখতে হচ্ছে। এর মাঝে বাকপটু নেতা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হেদায়েতনামা দিয়েছেন এ ধরনের কথাবার্তার ব্যাপারে। তিনি যেকোনো স্পর্শকাতর বিষয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্ব জ্ঞানহীন কথা বলতে নিষেধ করেছেন। রাজনৈতিক কোটার দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্বপালনের নমুনাতেই দলের সাধারণ সম্পাদককে প্রকাশ্যে এমন ঘোষণা দিতে হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/আরআইপি