টাইগারদের খেলা নেই। তাতে কি? খেলাপাগল আর ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ বাঙালি কিন্তু বসে নেই। ক্রিকেট অনুরাগিদের বড় অংশ ব্যস্ত ভারতের সাড়া জাগানো টি-টোয়েন্টি আসর ‘আইপিএল’ নিয়ে। যে আসরে সব নামি-দামি বিশ্ব তারকাদের সাথে আছেন বাংলাদেশের কোটি ক্রিকেট অনুরাগির প্রাণের তারকা সাকিব আল হাসান আর পেস সেনসেশন মোস্তাফিজুর রহমান।
Advertisement
সবাই অপেক্ষার প্রহর গোনেন, কবে সাকিবের ম্যাচ? কাটার মাস্টারের খেলা কোন দিন? প্রথম দিন রাতে ছিল মোস্তাফিজের মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের ম্যাচ। আজ রাতে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের নতুন দল সানরাইজার্স হায়দরাবাদের প্রথম খেলা।
অনুমান করা যায়, সোমবার সন্ধ্যা নামতেই রাজধানী ঢাকার রাস্তা-ঘাটে স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য কমে যাবে। ভক্তরা বসে যাবেন টিভির সামনে। অন্য সব বিনোদন চ্যানেল বাদ দিয়ে লাখ ক্রিকেট অনুরাগির চোখ স্থির থাকবে বাংলাদেশের চ্যানেল ৯, ভারতের স্টার জলসা আর স্টার স্পোর্টস সিলেক্ট ১ ‘এ।
এর বাইরে বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুরাগিদের মনের গহীনে আরও একটি প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগি বিষয়ও উকি ঝুঁকি দিচ্ছে। অনেকেরই কৌতুহলি জিজ্ঞাসা, ‘আচ্ছা, মোহাম্মদ আশরাফুল, শাহরিয়ার নাফীস আর নাইম ইসলাম এবারের প্রিমিয়ার লিগে দারুণ খেলেছেন। তাদের ভবিষ্যত কি?’
Advertisement
তারা তো আবার জাতীয় দলে ফিরতে উন্মুখ। আর সে কারণেই প্রায় মধ্য তিরিশে পা রাখা আশরাফুল এখনো প্রিমিয়ার লিগে সামর্থ্যের সেরাটা উপহার দিতে প্রাণপন সচেষ্ট ছিলেন। এক লিগে পাঁচ পাঁচটি সেঞ্চুরির নতুন রেকর্ডও গড়েছেন।
তার সম বয়সী শাহরিয়ার নাফীসও কম যাননি। এ বাঁহাতি টপ অর্ডারের ব্যাট থেকেও এসেছে একজোড়া শতক। তাদের চেয়ে কম বয়সে জাতীয় দল থেকে ছিটকে পড়া নাঈম ইসলামও দারুণ খেলেছেন। নাজমুল হোসেন শান্ত (৭৪৯) আর এনামুল হক বিজয়ের (৭৪৪) পর ৭২০ রান তোলায় তিন নম্বরে জায়গা করে নিয়েছেন নাঈম। এই তিনজনই কোনো না কোনো কারনে জাতীয় দলের বাইরে।
আশরাফুল অসৎ ও অন্যায় পথে হেঁটে ম্যাচ গড়াপেটার সাথে জড়িত হয়ে নিষিদ্ধ ছিলেন। আর শাহরিয়ার নাফীস ও নাঈম গত দুই তিন মৌসুম ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত রান করেও জাতীয় দলে সুযোগ পাননি। এখন প্রশ্ন উঠেছে, তারা কি আর জাতীয় দলে ফিরতে পারবেন? এই তিন পরিণত, প্রতিষ্ঠিত ও অভিজ্ঞ পারফরমারকে নিয়ে নির্বাচক ও টিম ম্যানেজমেন্টের চিন্তা-ভাবনাই বা কি? তা জানতে রাজ্যের কৌতুহল।
পত্র পত্রিকা, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিন এই চার সিনিয়র ক্রিকেটারকে নিয়ে বিস্তর লেখালেখি। টিভি চ্যানেলগুলোয়ও তাদের নিয়ে নানা প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে।
Advertisement
‘হ্যাঁ, এখনই জাতীয় দলে ফিরতে চাই’- মুখ ফুটে ঠিক এমন কথা না বললেও আশরাফুল, শাহরিয়ার নাফীস আর নাঈম আবার জাতীয় দলে ফেরার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তাদের মনের সুপ্ত বাসনাই হলো, আবার জাতীয় দলের হয়ে খেলা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বাইরে থেকে জাতীয় দলে ফেরার একমাত্র পথই হলো ঘরোয়া ক্রিকেটে বিশেষ করে ঢাকার প্রিমিয়ার লিগ, বিপিএল, জাতীয় লিগ ও বিসিএলে ভালো খেলা।
সবে শেষ হওয়া প্রিমিয়ার লিগে সেই কাজটি করে দেখিয়েছেন আশরাফুল, শাহরিয়ার নাফীস ও নাঈম। তারা তাদের কাজ করেছেন। এখন তাদের নিয়ে নির্বাচকরা কি ভাবছেন, সেটাই প্রধান বিবেচ্য।
প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু জাগো নিউজের সাথে ওই ইস্যুতে একান্তে কথা বলেছেন। সেখানে আশরাফুল , শাহরিয়ার নাফীস ও নাঈম ইসলামের আবার জাতীয় দলে ফেরা সম্পর্কে অনেক খোলামেলা মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচক। ওই তিন ক্রিকেটারের কাকে নিয়ে তাদের ভাবনা কেমন, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও আছে।
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে যে আসরটি এখন লিস্ট ‘এ’র মর্যাদা পাওয়া সেই প্রিমিয়ার লিগের এবারের আসরে সর্বাধিক পাঁচ সেঞ্চুরি করে রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন আশরাফুল। ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ মাথায় নিয়ে দ্বিতীয়বার প্রিমিয়ার লিগ খেলতে নামা আশরাফুলের ব্যাট থেকে রানের নহর বইয়ে গেছে।
বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে লিস্ট এ‘র এক আসরে পাঁচ শতরান করার পরও আশরাফুল অবশ্য এখনই বা নিকট ভবিষ্যতে জাতীয় দলে ফেরার চিন্তা করছেন না। সপ্তাহ দুয়েক আগে জাগো নিউজের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে আশরাফুল জানিয়েছিলেন, ‘আমি এখন জাতীয় দলে ফেরার কথা ভাবছি না। আমার মনে হয়, আমি এখন জাতীয় দলে খেলার জন্য তৈরি না।’
এই তৈরি না বলতে আশরাফুল আসলে কি বুঝিয়েছেন? সেটা কি ক্রিকেটীয়, না শারীরিক? আশরাফুলের কথায়ই ছিল তার ব্যাখ্যা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এখন জাতীয় দলে ফেরার চিন্তা করি না একটি যৌক্তিক কারণে। আগামী আগস্ট পর্যন্ত আমি এমনিতেই জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারবো না। আইসিসির নিষেধাজ্ঞা আছে। ওই সময়ের মধ্যে জাতীয় দলে ফেরা বা খেলার চিন্তা অমূলক। আর আমার ফিটনেস লেভেলও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উপযোগী না। আমাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে হলে শতভাগ ফিট হতে হবে। সেটা জাতীয় দলের যে আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন ফিটনেস ট্রেনিং আছে, সেটা করেই আমাকে ওই মানের ফিটনেস অর্জন করতে হবে।’
তার মানে আশরাফুল নিজের অবস্থান ও ইচ্ছে- পরিকল্পনা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন। আজ সকালে জাগো নিউজের সাথে আশরাফুল প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু তাদের চিন্তা-ভাবনার কথা বলেন। নান্নু বলেন, ‘হ্যাঁ, চিন্তা ধারা অবশ্যই আছে। এমন নয় যে, আশরাফুল, শাহরিয়ার নাফীস আর নাঈম আমাদের চিন্তায়ই নেই। আছে। তাদের নিয়ে আমাদেরও ভাবনা আছে। তবে সেখানে আবেগের কোনো জায়গা নেই। আমরা ক্রিকেটীয় যুক্তি মেনেই ভাবছি কি করা যায়।’
আশরাফুল প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচকের কথা, ‘প্রথমতঃ সে আগস্ট পর্যন্ত আইসিসির নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছে। তাই আগামী চার মাস তাকে নিয়ে ভাবার কিছুই নেই।’
প্রধান নির্বাচকের ভাবটা এমন, আগে আগস্টের নিষেধাজ্ঞা কাটুক। তারপর দেখা যাবে। আর সে কারনেই মুখে এমন কথা, ‘আশরাফুল তো ভালই খেলছে। খেলুক না আরও!’
আশরাফুলের এতগুলো শতরানকে আমলে আনা হচ্ছে। কিন্তু নান্নুর কথা, ‘সবগুলো সেঞ্চুরি বিকেএসপির মাঠে। অন্য মাঠে ভিন্ন উইকেটে আশরাফুল কেমন খেলে, সেটাও খুঁটিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমাদের অনেক কিছু ভেবে দেখতে হবে।’
নান্নুর এই মন্তব্যর তাৎপর্য অনেক। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে , শুধু মাঠের পারফরমেন্সই আশরাফুলের আবার জাতীয় দলে ফেরার একমাত্র সার্টিফিকেট নয়। তা যে নয়, তার ব্যাখ্যাও আছে। প্রধান নির্বাচক সরাসরি বলেছেন, ‘আশরাফুলের ফিটনেস খুঁটিয়ে দেখতে হবে। জাতীয় দলের সাথে তার বর্তমান ফিটনেসের ফারাক বিস্তর। আর তার বিষয়ে বোর্ডের অবস্থান কি, সেটাও জানতে হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।’
তার মানে দাঁড়ালো, প্রিমিয়ার লিগের পর বিসিএলে (আগামীকাল থেকে শুরু) ব্যাট হাতে ঝড় তুললেও লাভ হবে না। আগস্টের নিষেধাজ্ঞা মুক্তির আগে আশরাফুলের জাতীয় দলে ফেরা বহুদূরে, তার কথা বিবেচনায়ও আনার সুযোগ বা অবকাশ নেই।
আর তারপরও ভালো খেলাই শেষ কথা নয়। তার ভালো খেলা অব্যাহত থাকতেই হবে। ব্যাটে রানের ফলগুধারা বইতেই হবে। তারপর অপেক্ষায় থাকতে হবে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা কেটে গেলেও ম্যাচ ও স্পট ফিক্সিংয়ের সাথে জড়িত আশরাফুল আবার দলে ফিরলে জাতীয় দলের অভ্যন্তরে কোনোরকম নেতিবাচক পরিস্থিতির উদ্রেক ঘটবে কিনা, তাও ভাবা হবে। এসব খুঁটিনাটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খুঁটিয়ে দেখবে বোর্ড- এমন ইঙ্গিতও আছে নান্নুর কথায়।
সব ইতিবাচক মনে হলেই কেবল নির্বাচকদের কাছে তাকে বিবেচনায় আনার প্রস্তাব আনা হবে। তারপর আশরাফুলের দলে ফেরার প্রশ্ন। তার আগে নয়।
এআরবি/এমএমআর/পিআর