প্রায় ৬০ জন শ্রমিকের বিন্দু বিন্দু ঘামে ভবনের গায়ে ফুটন্ত ফুলের মতো টেরাকোটায় ফুটে উঠবে স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। তার পাশেই ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি মনে করিয়ে দেবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সেই দৃশ্য। ভবনের দেয়ালে ভেসে থাকবে বিশ্ব ঐতিহ্যের সেই প্রামাণ্য দলিল, রাজনীতির কবির সেই বজ্রকণ্ঠের উদ্ভাসিত জনস্রোতের চিত্র।
Advertisement
ভবনটির প্রবেশ মুখে দেখা যাবে চলন্ত নৌকা। তার পাশেই দেয়ালে স্মৃতিচিহ্নের মতো স্মরণীয় হয়ে থাকবে দেশের রাজনীতির ইতিহাসের এক কালো দিন। ভবনটির এক পাশে লেখা থাকবে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় এই চার মূলনীতির রক্তাক্ত শপথ। ভবনের প্রতিটি তলায় থাকবে ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা চিহ্ন।
আটষট্টি বছরের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রাণকেন্দ্র এই ভবনটি। রাজধানীর ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের এই ঠিকানায় দলটির কেন্দ্রীয় কার্যক্রম শুরু হয় ৩৭ বছর আগে। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা দেশের ফেরার পর পুরনো ভবনের এই জায়গায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থাপন করা হয়। ২০১৭ সালের ২৩ জুন দলটির ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলতি বছর দলের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নতুন এই ভবনের উদ্বোধন করার পরিকল্পনা রয়েছে। ভবনটির নির্মাণে সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি থাকবে, নৌকা থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির চিহ্ন থাকবে।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে রোববার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় ভবন নির্মাণ কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলী ইমাম হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আরও ৩ মাস আগেই ভবনের মূল কাঠামোর কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে ইন্টেরিয়র ও সাজসজ্জার কাজ। সব কিছু ঠিক থাকলে সময় মতোই কাজ শেষ হবে। তিনি জানান, ভবনের সামনের দিকের দেয়ালে ৪, ৫, ৬ ও ৭ তলার জায়গাজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের চিত্র থাকবে, যা নির্মাণে ব্যবহৃত হবে টেরাকোটা। তাঁর পাশেই থাকবে ৫২’র ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের স্মৃতি চিহ্ন। এর নিচের দিকে এস এস স্টিলের তৈরি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা।
Advertisement
ভবনটির প্রবেশমুখের বামপাশে লেখা থাকবে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র রাষ্ট্র পরিচালনার এই চার মূলনীতি। তার পাশের দেয়ালে মাটি অথবা টাইলসে খচিত হবেন নারী নেত্রী আইভী রহমান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত হওয়া এই নারী নেত্রীর স্মৃতিচিহ্নই এটি। ভবনে প্রবেশ মুখ থেকে যে দেয়ালটি দেখা যাবে সেখানে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান এই প্রকৌশলী। কমফোর্ট নামের একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় নির্মাণকাজ করছে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফোরম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন আবদুল গণি। তিনি জানান, ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। ছাদ দেয়ার কাজ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। একটা নৌকা বানাবে, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল বানানোর কাজ চলছে। ম্যুরালের কাজ যারা করবে, তারা এসে নিয়ে গেছে। আশা করছি যথা সময়ে কাজ শেষ করতে পারব।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দলের নিজস্ব ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য বিশ্বমানের ভবনটির সামনের দু'পাশের দেয়াল কাচ দিয়ে ঘেরা থাকবে। আর মাঝখানে সিরামিকের ইটের বন্ধনে গড়ে উঠবে। এর সামনের দেয়ালজুড়ে দলের সাইনবোর্ডসহ দলীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’, রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি, ভাষা আন্দোলন-৫২, মুক্তিযুদ্ধ-৭১ প্রভৃতি শব্দ খোদাই করে লেখা থাকবে। ভবনের সামনে-পেছনে হবে ফুলের বাগান। জানা গেছে, ১০ তলা বিশিষ্ট এ ভবনে ৪ ও ৫ তলায় থাকবে আওয়ামী লীগের সহযোগী-অঙ্গসংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিমসহ সমমনা অন্যান্য সংগঠনের কার্যালয়। সাত, আট ও নয়তলায় দলীয় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের কক্ষ থাকবে।
ভবনের বিভিন্ন তলায় থাকবে ডিজিটাল লাইব্রেরি, সেমিনার রুম এবং সাংবাদিক লাউঞ্জ। আধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিতব্য ভবনটিতে থাকবে দুটি স্বতন্ত্র কার পার্কিং, একাধিক লিফট, সিঁড়ি, কার লিফটসহ ভূমিকম্প ও অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা। ভবনের ছাদে থাকবে হেলিপ্যাড, যেখানে সরাসরি হেলিকপ্টার অবতরণ করতে পারবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, আমরা আশা করছি, ২৩ জুন দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দলীয় সভাপতি আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ভবনটির কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পুরাতন ভবন ভাঙার কাজ শুরু হয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাশ লেনের রোজ গার্ডেনে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী লীগের। এরপর আওয়ামী লীগের কার্যালয় স্থানান্তরের ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার।
Advertisement
এইউএ/ওআর/জেআইএম