২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম শেষে একাত্তরের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল উদার, অসাম্প্রদায়িক, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার। কিন্তু ’৭৫এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ আবার ভুতের মত পেছনের পায়ে হাঁটতে শুরু করে। ২১ বছর ধরে চলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি। ৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনে শুরু ইতিহাসের পেছনের দিকে চলা চাকাকে সামনের দিকে নেয়ার।
Advertisement
’৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শুরু হয় ইতিহাস পুনঃপাঠ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে। মুক্তিযুদ্ধের মতই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ ও ইতিহাসের পুনঃপাঠের আন্দোলন যেন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। সেই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসেনানী ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। একাত্তরে পিতাকে হারানোর পর পারিবারিক বিপর্যয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারার গ্লানি মুছে দিতে চেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে। পেশায় শিক্ষক, থাকেন সিলেটে। তবু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, প্রগতিশীল সব আন্দোলনে সামনের কাতারেই পাওয়া যায় জাফর ইকবালকে। অথচ হতে পারতো উল্টো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে আরামে আয়েশে কাটিয়ে দিতে পারতেন গোটা জীবন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। সপরিবারে ফিরে এসেছেন দেশে। ফিরে এসেও ঢাকার কোনো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বেছে নিয়েছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেই জাফর ইকবালের কল্যাণে। সেই প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চেই হামলা হলো জাফর ইকবালের ওপর, হামলা হলো আসলে মুক্তচিন্তার ওপর।
জাফর ইকবালের লড়াইয়ের মূল হাতিয়ার তার কলম। ছোটদের জন্য মুক্তিযদ্ধের ইতিহাস লিখেছেন। বিরামহীনভাবে লিখে যাচ্ছেন শিশু-কিশোরদের জন্য। তার সব লেখায়ই থাকে মুক্তিযুদ্ধ। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদের পর জাফর ইকবালই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তিনি ফিকশন লেখেন, নন-ফিকশন লেখেন, সায়েন্স ফিকশন লেখেন। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কলাম লেখেন। তাঁর পছন্দের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ, বিজ্ঞান, শিক্ষা। তিনি জানেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়তে চাই মুক্তচিন্তার, মুক্তবুদ্ধির, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী প্রজন্ম।
Advertisement
আর ছেলেবেলা থেকেই শিশুদের মধ্যে এই বিষয়গুলো গেঁথে দিতে পারলেই গড়ে উঠবে কার্যকর প্রজন্ম। আর এটাও তিনি জানেন, মুখে বড় বড় কথা বললে বা বড় বড় উপদেশ দিলে শিশুরা সেটা শুনবে না। তাই গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি শিশুদের শেখাতে চান বিজ্ঞান, জানাতে চান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। শুধু লিখেই ক্ষান্ত নন তিনি। সমারাদেশে ঘুরে ঘুরে গণিত অলিম্পিয়াড, ভাষা প্রতিযোগ ধরনের নানা আয়োজনে শিশুদের অনুপ্রাণিত করেন। গণজাগরণ মঞ্চে এসে, স্লোগান দেন- জয়বাংলা। শিশুদের শিক্ষা নিয়ে তাঁর ভাবনার অন্ত নেই।
মৌলবাদীরা যে শিশু-কিশোর-তরুণদের মগজ ধোলাই করে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করছে, তার বিপরীতে সবচেয়ে কার্যকর লড়াই হলো সেই শিশু-কিশোরদের সত্যিটা জানতে দেয়া। তাদের জীবনের আনন্দটা বুঝতে দেয়া। এই কাজটাই জাফর ইকবাল করে যাচ্ছিলেন বিরামহীনভাবে, সাহসের সাথে। আমরা যে টুকটাক লেখালেখি করি, তারও অনুপ্রেরণা কিন্তু এই জাফর ইকবালই। তাঁর সাহস সঞ্চারিত হয় অনেকের মধ্যে।
যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তারা জানেন জাফর ইককাল নরম সরম মানুষ। তিনি মানুষকে ভালোবাসেন, শিশুদেও আগলে রাখেন পরম মমতায়। কিন্তু আদর্শের প্রশ্নে আপষহীন। এ কারণেই মৌলবাদী অন্ধকার শক্তির কাছে জাফর ইকবাল এক আতঙ্কের নাম। তাই মৌলবাদীদের প্রথম টার্গেট জাফর ইকবাল। যারা জানেন এক জাফর ইকবাল তাদেও যতটা ক্ষতি করতে পারবেন, কোটি মানুষও তা পারবে না। দেশের কোটি মানুষ যেমন তাঁকে ভালোবাসে। আবার অল্প কিছু অন্ধকারের জীব তাঁকে অপছন্দও করে।
ফেসবুকেও দেখি অনেকেই তাঁর নাম বিকৃত করে সম্বোধন করে। তাঁকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে। তবে বরাবরের মত যা হয়, এই অন্ধকার শক্তি যুক্তির জবাবে পাল্টা যুক্তি দেয় না। তাদের যুক্তি হলো চাপাতি, ছুরি, অস্ত্র। তারা হামলা চালায় পেছন থেকে। জাফর ইকবাল অনেকদিন ধরেই তাদের হিটলিস্টে ছিলেন। সেই হামলাটা হলো গত শনিবার। বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুক্তমঞ্চে একটি রোবট প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি। মুক্তমঞ্চে পুলিশ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিল। এরই মধ্যে হামলাকারী পেছন থেকে ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
Advertisement
আহত হয়েও কাবু হননি জাফর ইকবাল। রক্তমাখা গায়েও তিনি ঠান্ডা মাথায় নিজের রক্তের গ্রুপ বলেছেন, সবাইকে শান্ত থাকতে বলেছেন। ধরা পড়া হামলাকারীকে যেন না মারা হয় তার অনুরোধ করেছেন। অন্ধকারের শক্তির সাথে মুক্তচিন্তার মানুষের পার্থক্য এখানেই। দ্রুতই তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। তার মাথায়, পিঠে ২৬টি সেলাই লেগেছে। চার ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। রাতেই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় এনে সিএসমএইচে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত।
ট্র্যাজেডিটা হলো শহীদ ফয়জুর রহমানের ছেলের ওপর হামলাকারীর নামও ফয়জুর রহমান। এই ফয়জুর মাদ্রাসার ছাত্র। হামলাকারীর অন্য দুই ভাইও মাদ্রাসায় পড়ে, তাদের বাবা মাদ্রাসার শিক্ষক। তবে কেউ দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার ওপর বিষোদগার শুরু করে দেবেন না। মাদ্রাসার গরীব ছাত্রদের আমরা মৌলবাদীদের হাত থেকে নিরাপদ করতে পারিনি, এটা আমাদের ব্যর্থতা।
মাদ্রাসার ছাত্ররা মৌলবাদীরদের সহজ শিকার বটে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, জঙ্গিবাদের থাবা এখন অনেক বিস্তৃত। নিব্রাসদের মত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও তাদের মগজ ধোলাই প্রকল্পের শিকার। এই ২০/২২ বছরের ফয়জুরের ওপর ঘৃণার পুরোটা ঢেলে দিলে আড়ালেই থেকে যাবে মূল পরিকল্পনাকারীরা। ধরতে হবে তাদেরও। আর যে কারণে মৌলবাদের বিস্তার ঘটছে, বাধ দিতে হবে সেখানে। একবার মগজ ধোলাই করে মাঠে ছেড়ে দিলে; সেই তরুণটিকে পিটিয়ে মেরে ফেললেই জঙ্গিবাদ নির্মূল হবে না।
জাফর ইকবাল নিছক একজন ব্যক্তি নন। তাঁর ওপর হামলাও নিছক ব্যক্তির ওপর হামলা নয়। এ হামলা মুক্তচিন্তার ওপর, মুক্তবুদ্ধির ওপর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর। তাই এই হামলার বিরুদ্ধে সকল শুভ শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়তে হবে। সবচেয়ে আগে চাই রাষ্ট্রীয়ভাবে মৌলবাদী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা। পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণের দায়ীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। ভোটের হিসাবের উর্ধ্বে উঠে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সত্যিকারের জিরো টলারেন্সে আঘাত হানতে হবে।
কৌশলের আড়ালেও কোনো আপস করা যাবে না। আর জাফর ইকবাল যে কাজটি করছিলেন, মগজ ধোলাইয়ের পাল্টা শিশুদের মগজে মননে গেঁথে দিতে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তচিন্তা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে, মুক্তচিন্তাকে নাস্তিক্যবাদের সাথে গুলিয়ে ফেলে ইসলাম বিরোধী চিন্তা যারা ছড়িয়ে দিতে চান; তারাই ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু। এদের মোকাবেলা করতে হবে।
মৌলবাদীরা জাফর ইকবালের ওপর হামলা করে সবাইকে ভয় দেখাতে চেয়েছে। আমরা যদি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাই, গুটিয়ে যাই; তাহলে তারা সফল হবে, তাদের বিজয় হবে। তাদের ব্যর্থ করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, আরো বেশি করে বলা, আরো বেশি লেখা; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যথার্থ বিকাশ।
ড. জাফর ইকবালের স্ত্রী একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. ইয়াসমিন হক যথার্থই বলেছেন, তাদের হামলায় ভীত হয়ে তারা জেলখানায় বন্দী থাকবেন না। ফেসবুকে ভার্চুয়াল বিপ্লবের পাশাপাশি আমাদের নিজ নিজ থেকে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হবে। নইলে আমাদের অসহায়ের মত সংখ্যা গুণে যেতে হবে। আর আহাজারি করতে হবে, এরপরে কে?
৪ মার্চ, ২০১৮
এইচআর/পিআর