‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’- স্লোগানে একদিন কেঁপে উঠেছিল এই ভূখণ্ড। মাত্র আজ থেকে ছয়-সাত দশক আগের ঘটনা। বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার বহন হিসেবে মাতৃভাষার দাবিতে এবং অফিস আদালতে সর্বত্র বাংলা ভাষায় কার্যক্রম চালানোর মহৎ অভিপ্রায়ে সেদিন জীবন দান করতেও কুণ্ঠিত হননি বাংলা মায়ের বীর সন্তানরা।
Advertisement
কিন্তু আজ সেই একই ভূখণ্ডে আমরা কী দেখছি? কী ভাষায় কথা বলছি আমরা? কোন ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করছে আমাদের সন্তানরা? কোন ভাষায় কথা বললে অফিসে আদালতে বাড়তি সম্মান পাওয়া যাচ্ছে?
শুরু করি এফ এম রেডিওর অনুষ্ঠান উপস্থাপকদের অবস্থা দিয়ে। বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি মিলিয়ে অদ্ভুত এক জগাখিচুড়ি ভাষায় মাইক্রোফোনের সামনে অবিরল বকবক করছে এরা। ‘ধামাকা’, ‘মাস্তি’, ‘কঠিন প্রেম’, ‘আজিব’ ইত্যাদি শব্দ শুনে চমকে উঠতে হয়।
সুললিত বাংলায় কথা বলে এক সময় রেডিওর অনুষ্ঠানেই অসংখ্য শ্রোতাকে মুগ্ধ করতেন আমাদের সংস্কৃতিকর্মীরা। আর আজ কিভাবে বিকৃত ভাষায় কথা বলছে এরা তা ভেবে মন বিষাদে ভরে যায়।
Advertisement
টিভির নাটকেও বিকৃত ভাষায় সংলাপ আজকাল হরহামেশাই চলছে। কোন বিশেষ অঞ্চলের জনগোষ্ঠির জীবন ফুটিয়ে তোলার প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা যেতেই পারে। সেটা বরং শিল্প-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু যেখানে দেখানো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষকও কথা বলছে কোন বিশেষ অঞ্চলের নয় বরং মনগড়া এক বিকৃত ভাষায় তখন তা দুঃখজনক বৈকি। প্রমিত বাংলায় কথা বললে কি নাটকের নাটকীয়তা কবে যাবে বলে এই সব নাট্যকাররা মনে করেন নাকি তারা নিজেরাই প্রমিত বাংলায় লেখার যোগ্যতা রাখেন না? আজকাল অনেকে লেখালেখিও করছেন এমনি এক বিকৃত ভাষায়।
বাংলা ভাষার বহতা নদী অনেক বিশাল। সেই নদীর পথকে এরা পরিবর্তন করতে পারবে না তা ঠিক, তবে কিছুটা কলুষিত করতে পারবে নিশ্চয়ই। বাংলাভাষাকে দূষণমুক্ত রাখতে এ ধরনের বিকৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে সবাইকে।
এবার আসা যাক শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে। স্কুল কলেজে ইংরেজি মাধ্যমের রমরমা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করে নিতে হলে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হতেই হবে সেকথা ঠিক। কিন্তু একটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করার জন্য শিক্ষার মাধ্যম পালটে ফেলতে হবে কেন?
চীন দেশে দেখেছি তারা বর্তমানে ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জন করতে উদগ্রীব। ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনের জন্য তারা আলাদাভাবে ইংরেজি শেখার স্কুল খুলছে। তাছাড়া স্কুলে কলেজে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য আলাদা বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু তাই বলে তারা শিক্ষার মাধ্যমকে ইংরেজি করেনি। বিজ্ঞান, গণিত এসব তারা শিখছে মাতৃভাষাতেই। শুধু ভাষা শেখার জন্য ইংরেজির আলাদা ক্লাস হচ্ছে।
Advertisement
নতুন প্রজন্মের চীনারা যথেষ্ট দক্ষ হচ্ছে ইংরেজিতে। কিন্তু তাই বলে তারা যে চীনাভাষা ছেড়ে ইংরেজিতে কথা বলছে বা চীনাভাষার মধ্যে ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে দিচ্ছে তা মোটেই নয়। বরং মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে প্রতিটি নতুন প্রযুক্তির সামগ্রীর চীনা নাম রয়েছে। তারা সেই শব্দগুলোই ব্যবহার করেছে। কোন মিশ্রভাষায় তারা কথা বলছে না।
আমেরিকাতে দেখেছি স্কুলে ফরাসি বা অন্য কোন একটি বিদেশি ভাষা শেখার ব্যবস্থা রয়েছে। যাতে ইংরেজির পাশাপাশি অন্য কোন একটি ভাষা শিক্ষার্থীরা শিখতে পারেন। সেটা তারা ভাষা হিসেবে শিখছে এবং সেই ভাষায় বেশ দক্ষতা অর্জন করছে। কিন্তু তাই বলে শিক্ষার মাধ্যম কিন্তু ফরাসি বা অন্য কোন ভাষা হচ্ছে না।
আমাদের স্কুলে কলেজে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদান চলছে। প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি শিখছি আমরা। তারপরও শ্রীলংকা বা ভারতের নাগরিকদের মতো ইংরেজি বলতে পারি না। এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে না সাজানো অবধি পারব বলেও মনে হয় না।
আর চাকরিক্ষেত্রে বলা যায় যে যত ইংরেজি বলতে পারে তারই ততো কদর। একজন কর্মী তার কাজে দক্ষ হয়েও শুধু ইংরেজি বলতে না পারার কারণে ম্রিয়মাণ থাকেন। অন্যদিকে কাজ না পারলেও ইংরেজিতে শুধু বকবক করতে পারলেও বসের সুনজরে থাকা যায়।
ইংরেজি বলতে পারাটাই এখানে যোগ্যতা হিসেবে গণ্য। আমাদের ভাষার জন্য এটি বড় অপমানজনক। আর হিন্দি ভাষায় কথা বলার জন্য অনেকে তো মনে হয় উদগ্রীব হয়েই থাকেন। গায়ে হলুদ বা বিয়ে বাড়িতে হিন্দি গান না বাজালে চলবেই না। অথচ বাংলায় কি ভালো সুরে ভালো কথার গান নেই?
অনেক আাছে। কিন্তু বাংলা গানের তালে নাচলে লোকে আধুনিক ভাববে না, তাই চাই ধুমধারাক্কা হিন্দি গানের পিলে চমকানো আওয়াজ।এগুলো জাতি হিসেবে আমাদের হীন করে তোলে। আজকাল অনেক বিয়েবাড়িতে শুধু হিন্দি গান নয়, হিন্দি সিনেমার অনুকরণে লেহাঙ্গা পরতে দেখা যায় কনেকেও। শাড়িতে বাঙালি নারী চিরদিন সুন্দর। বিশেষ করে বিয়ের কনে কেন বিজাতীয় পোশাক পরবে? এর কোন উত্তর নেই। এই সব অপসংস্কৃতি দূর করতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচয়বাহী অনুষ্ঠানগুলো জাঁকিয়ে তুলতে হবে।
বইমেলায় শিশুকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বাংলা ভাষাার রতœরাজির খোঁজ দিতে হবে। তাহলে আর বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রতি তার আগ্রহ সেভাবে জন্মাবে না। যে গাছের শিকড় মাটির যত গভীরে থাকে সে ততোই মজবুতভাবে দাঁড়িযে থাকে। শিকড় ছাড়া গাছ অল্প ঝড়েই কাত হয়ে যায়।
আমাদের শিশুদের হাত ধরে তাই শিকড়ের দিকে নিয়ে যেতে হবে। হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন। এই রত্নরাজির খোঁজ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারলে সাংস্কৃতিক দেউলেপনা দূর হতে দেরি হবে না।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/পিআর