পেশায় ফুচকা বিক্রেতা। ঠাকুরগাঁওয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবকের কাছে আজিজ ভাই নামেই পরিচিত তিনি। শহরের সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের পাশের একটি ছোট ফুচকার দোকান করে জীবিকা-নির্বাহ করেন। সারাদিন অনেক কিছু খাওয়া হলেও তার হাতের ফুচকা না খেলে মনের তৃপ্তি মেটে না এমটাই মনে করেন ফুচকাপ্রেমীরা।
Advertisement
কিন্তু এ ফুচকা বিক্রেতার আরেকটি পরিচয় রয়েছে। সেটি হচ্ছে তিনি একজন চিত্রশিল্পী। দিন শেষে রাতে বাড়ি ফিরে কাঠ-পেন্সিল দিয়ে বিভিন্ন ছবি আঁকেন। নিপুণ হাতে যেমন সুস্বাদু ফুচকা বানান তেমনি কাঠ-পেন্সিলের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতাধিক ছবি এঁকেছেন তিনি। বলছি, ঠাকুরগাঁওয়ের ফুচকা বিক্রেতা চিত্রশিল্পী আব্দুল আজিজের কথা।
তার অাঁকা ছবিগুলো প্রদর্শনী করার ইচ্ছা থাকলেও অর্থের অভাবে করাতে পারেননি আজিজ। অবশেষে জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়ালের সার্বিক সহযোগিতায় ভাষার মাসে ঠাকুরগাঁওয়ের বইমেলায় তার চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দিয়ে স্বপ্ন পূরণ করেছেন বলে ফুচকা বিক্রেতা আজিজ জানিয়েছেন।
তার আঁকা ছবি দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছে মানুষ। আজিজের অসাধারণ প্রতিভা দেখে মুগ্ধ সবাই। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন প্রতিভা লুকিয়ে আছে এটা দেখে সবাই অবাক।
Advertisement
আমরা জানি প্রতিটি মানুষের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা থাকে। শুধু সেই প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ প্রয়োজন। কেউ হয়তো পারে আবার কেউ হয়তো ব্যর্থ হয়। আর যারা পারে তাদের জীবনের গল্পগুলো হয় অন্যরকম।
সেটিই প্রমাণ করলেন প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী ঠাকুরগাঁওয়ের ফুচকা বিক্রেতা আব্দুল আজিজ। যিনি কাঠ-পেন্সিলের মাধ্যমে তৈরি করেন তার চিত্রকর্ম। এখন সবার কাছে তিনি শুধু ফুচকা বিক্রেতা নয় একজন চিত্রশিল্পীও।
ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় বড়মাঠে তার অস্থায়ী ফুচকার দোকান। এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন ১৯৭৯ সাল থেকে। কাজের অবসরে আঁকতেন বিভিন্ন ছবি। এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ছবি এঁকেছেন। এর আগে ছোট পরিসরে তার ছবি নিয়ে হয়েছে একক চিত্র প্রদর্শনী। এবারই প্রথম বড় পরিসরে তার ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে।
চিত্রশিল্পী আজিজ বলেন, আমি নাইট স্কুলে পড়ালেখা করেছি। দিনের বেলা হোটেলে কাজ করে রাতে পড়তে যেতাম। বাবা যুদ্ধে মারা যান। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। সংসার মূলত বড় ভাই চালাতেন।
Advertisement
পরবর্তীতে ভর্তি হই ঠাকুরগাঁও রিভারভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করি। এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হই। এরপর ঢাকায় চলে যাই। পরবর্তিতে ঢাকাতে একটি ফাস্টফুডের দোকানে কাজ করি। সেখানে রাতে পেন্সিল আর কাগজ দিয়ে ছবি আঁকি। মূলত শুরুটা এভাবেই।
ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছবি আঁকার আগ্রহ ছিল ছোটকাল থেকেই। আমার বন্ধুরা ছবি আঁকতো। ওদের বলেছিলাম আমাকে শেখাতে। ওরা ঠাট্টা-টিটকারি কলে আমাকে বলেছিল, তুই পড়ালেখা জানিস না, তুই আঁকবি ছবি! এ কথা শোনার পর আমার মধ্যে একটা জেদ তৈরি হয়। প্রতিজ্ঞা করি, আমি দেখিয়ে দেব। সেই জেদ থেকেই আমার ছবি আঁকা শুরু।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে ছবি আঁকা আমার ভালো লাগে। কে দেখল আর কে দেখল না তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার স্বপ্ন এটা। আমি ঢাকায় এতদিন থাকলে হয়তো ভালো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমি পারিনি সংসারের কারণে, পরিবারের কারণে। এখন ঢাকায় একটি প্রদর্শনী করতে পারলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে।
ঠাকুরগাঁওয়ে বইমেলায় আসা দর্শনার্থীরা একবার হলেও আজিজের চিত্র প্রদর্শনী দেখেন। চিত্র প্রদর্শনী দেখার পরে কথা হয় দর্শনার্থী শাকিল চৌধুরীর সঙ্গে। তার কাছে চিত্র প্রদর্শনী কেমন লাগলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ছোট থেকে আজিজ ভাইয়ের দোকানে চটপটি-ফুচকা খাই। অনেক মজাদার ও সুস্বাদু তার হাতের ফুচকা। কিন্তু আজকে আমি অবাক। কারণ তার চিত্রগুলো দেখার পর মনে হয়েছে একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন প্রতিভা লুকিয়ে আছে তাকে দেখে বুঝাই যায় না।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল বলেন, আজিজ ভাইয়ের প্রতিভা হচ্ছে একটি ছাই চাপা আগুন। এটা যে কোনো সময় বের হয়ে আসতো। আজিজ ভাইয়ের মতো এমন অনেক শিল্পী ঠাকুরগাঁওয়ে আছেন। যাদের একাডেমিক শিক্ষা নেই। কিন্তু সুন্দর আর্ট করেন। আমরা চেষ্টা করবো এরপর সবার চিত্রগুলো তুলে ধরতে। আজিজ ভাইকে দেখে আমরা শিক্ষা নেব, চেষ্টা থাকলে প্রতিভা বিকশিত হবেই।
রবিউল এহসান রিপন/এএম/জেআইএম