খেলাধুলা

নায়ক হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করলেন লিটন

চাপের মুখে নিজের স্বভাবসুলভ স্ট্রোক প্লে তথা শটস খেলার চিন্তা ও চেষ্টা বাদ দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধৈর্য্য ধরে উইকেট আগলে রেখেছিলেন। মুমিনুল হকের সাথে সংকটে দারুণ জুটি গড়ে ম্যাচ বাঁচানোর সংগ্রামেও বেশ ভালমতই অংশ নিলেন।

Advertisement

মুমিনুল উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করে আউট হবার পর লিটনের সামনে সুযোগ ছিল সাহসী ও দক্ষ নাবিকের মত দলকে নিরাপদে তীরে ভেড়ানোর; কিন্তু চা বিরতির ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ পুরনো রোগ মাথাচাড়া দিল।

শতরানের খুব কাছে গিয়ে মনে হলো নাহ, অনেক তো ধৈর্য্যর পরিচয় দিলাম, এখন হেরাথকে ছক্কা হাঁকিয়ে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটা পূর্ণ করি। ব্যাস সেটাই কাল হলো। বাঁ-হাতি হেরাথের বলে সোজা তুলে মারা শটটি আকাশে অনেকদুর ভেসে লং অফে গিয়ে ধরা পড়লো ফিল্ডার পেরেরার হাতে। তাতেই প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটি হলো হাতছাড়া।

শুধু সেঞ্চুরি মিস নয়, হিরো থেকে রীতিমত ‘ভিলেন’ হতে যাচ্ছিলেন লিটন। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ শেষ দিকে হাল না ধরলে মুমিনুলের দুই ইনিংসে শতরান আর লিটন দাসের ৯৪ রানের দারুণ সহায়ক ইনিংসে সাজানো ইনিংস দুটি ভেস্তে যাবার উপক্রম হয়েছিল।

Advertisement

কারণ, মুমিনুল (১০৫) আর লিটন (৯৪) যখন আউট হলেন তখনো বাংলাদেশ শতভাগ শঙ্কা বা বিপদমুক্ত অবস্থায় ছিল না। অলআউট হবার পর্যাপ্ত সময় বাকি ছিল। আর তেমন কোনো লিডও তৈরি হয়নি। সৌভাগ্য লিটনের সেখান থেকে মাহমুদউল্লাহ অধিনায়কের ভুমিকা নিয়ে দলকে রক্ষা করেছেন। হার এড়িয়ে দিয়েছেন।

মুমিনুল আউট হওয়ার পর অধিনায়কের সাথে হার না মানা সেঞ্চুরি করে সাজঘরে ফিরতে পারলে অনিবার্যভাবে বীরোচিত সংবর্ধনা পেতেন লিটন। নায়কও বনে যেতে পারতেন।

কিন্তু ওই যে উচ্চাভিলাসি শট খেলার প্রবণতা! সেটাই শেষ পর্যন্ত কাল হলো লিটনের জন্য। অনেকক্ষণ ধৈর্য্য ধরেও শেষ পর্যন্ত উইকেটে টিকে থাকতে পারলেন না। সমালোচকদের মুখে ছাই দিয়ে নিজের সামর্থ্য প্রমাণের দিনটি স্মরণীয় করে রাখার পথে অনেকদুর গিয়েও শেষ মুহূর্তের ভুলে আবারো অতৃপ্তিই সঙ্গী হলো।

এই অতিমাত্রায় উচ্চভিলাসি শট খেলার প্রবণতা কিন্তু তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। ২০১৫ সালের (১০-১৪) জুন মাসে অভিষেকে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি না হাঁকিয়েও দারুণ নজর কেড়েছিলেন তিনি। আজ যেমন ছয় রানের জন্য সেঞ্চুরি পাননি, ওই ম্যাচেও ভারতের শক্তিশালী বোলিংয়ের বিপক্ষে উইকেটের চারদিকে বাহারি শট খেলে আউট হয়ে গিয়েছিলেন ৪৪ রানে।

Advertisement

তার মানে সে ম্যাচেও হাফ সেঞ্চুরির জন্য আক্ষেপ ছিল ৬ রানের। ফতুল্লায় ভারতের পেসার বরুন অ্যারোন, ফাস্ট বোলার উমেশ যাদব আর দুই অফ স্পিনার হরভজন সিং ও রবিচন্দন অশ্বিনের মত বোলারকে তুলোধুনো করে ছেড়েছিলেন তখনকার ২০ বছর বয়সী লিটন দাস। ওই মধ্য চল্লিশের ইনিংসটি ছিল পুল, স্কোয়ার কাট, কভার ড্রাইভ আর অন ড্রাইভে সাজানো। সাথে উইকেট ছেড়ে বেড়িয়ে লং অফ, লং অনের ওপর দিয়ে অনায়াসে তুলে মারার সামর্থ্যরে দলিলও ছিল। স্পিনে সুইপ শতভাগ নিরাপদ ও যথার্থ সুইপ খেলার সামর্থ্যরে প্রমাণও মিলেছিল তার ইনিংসে।

ওই সিরিজ কভার করতে আসা ভারতের সিনিয়র সাংবাদিকদের চোখ কপালে! কলকাতার এক সিনিয়র ঝানু ক্রিকেট লিখিয়ে প্রেসবক্সে প্রশ্নই করে বসলেন, এই পুঁচকে ছেলেটা কে গো? এমন বুকভরা সাহস আর তেজ!

এমন উদ্ভাসিত সূচনার পর মনে হচ্ছিলো, অনেক মেধাবি এক ব্যাটসম্যান উঠে আসছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে। যার ব্যাট শুধু আলোই ছড়াবে না, প্রতিপক্ষ বোলারদের নাভিশ্বাস ওঠাবে না, টিম বাংলাদেশেরও বড় সম্পদ হবে।

কিন্তু হায়! দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সে ধারনা অমূলক মনে হতে থাকে। দিনকে দিন অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাসি শট খেলার চেষ্টার কারণে তার মেধার সত্যিকার স্ফুরণ ঘটেনি। উল্টো ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি হয়েছে। সেই না পারাটাই জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের।

এমন চোখ ধাঁধানো সূচনার প্রায় আড়াই বছর পরও লিটন দাসের মান, মেধা ও সামর্থ্য প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকের মনেই সংশয়, ‘আচ্ছা লিটন দাস কি সত্যিই মেধাবি ব্যাটসম্যান? তার মাঝে কি বড় ব্যাটসম্যান হওয়ার গুণাবলি আছে?’ তাই বড় অংশের কাছে লিটন ‘খারাপ ব্যাটসম্যান’ হয়েই ছিলেন এতদিন।

লিটনের সত্যিকার সামর্থ্যরে প্রমাণের একমাত্র মানদন্ড ছিল, ব্যাট হাতে ভাল খেলা আর জাতীয় দলের পক্ষে বড় ইনিংস বা সেঞ্চুরি উপহার দেয়া। লিটন দাস খুব ভাল খেলে সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারলেই কেবল ওই অভিযোগ ও ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ আর সমালোচনা যে মিথ্যে, ভিত্তিহীন- তা প্রমাণ করতে পারতেন। এতকাল যা পারেননি।

এই টেস্টের প্রথম ইনিংসে খুব দৃষ্টিকটুভাবে আউট হয়েছিলেন লিটন। পেসার সুরঙ্গা লাকমালের ভিতরে আসা ডেলিভারি অফ স্ট্যাম্পের ঠিক বাইরে পড়ে আরও বেরিয়ে যাবে ভেবে, ছেড়ে দিয়ে বোল্ড হয়ে গেলেন। তার চিন্তা-ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে বল ভিতরে এসে অফ স্ট্যাস্প ভেঙ্গে দিল।

সাকিব নেই। আগের দিন পড়ন্ত বিকেলে ছোট্ট ঝড়ে দুই মূল স্তম্ভ তামিম ও মুশফিক আউট। দ্বিতীয় ইনিংসে ম্যাচ বাঁচাতে মুমিনুল, মাহমুদউল্লাহ, লিটন দাস ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের অন্তত দুজনার দীর্ঘ ইনিংস ও বড় জুটি খুব দরকার ছিল।

একে তো সামর্থ্য প্রমাণের দায়, তারওপর প্রথম ইনিংসে বাজে ভাবে শূন্য রানে ফেরার মানসিক চাপ- সব মিলিয়ে লিটনের ওপর ছিল পাহাড় সমান চাপের বোঝা। লিটন কি পারবেন এমন কঠিন পরিস্থিতিতে মেধার সত্যিকার স্ফুরণ ঘটাতে? না আবার ব্যর্থতার ঘানি টানবেন। ভক্তরা উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় অপেক্ষায় ছিলেন দেখতে।

অবশেষে সব উদ্বেগ-উৎকন্ঠার অবসান ঘটিয়ে ব্যাট হাতে ঠিকই জ্বলে উঠলেন লিটন দাস। মুমিনুল হকের সাথে চরম বিপদে ১৮০ রানের মহামুল্যবান পার্টনারশিপ গড়ে তুললেন। রোববার সকালে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে শুরুতে মিনিট দশেক একটু আড়ষ্ট ছিলেন। ছটফট করেছেন।

ওয়ানডে মেজাজে ব্যাকরণ না মেনে কখনো অন সাইডে সরে অফসাইডে জায়গা তৈরি করে মারতে চেয়েছেন। আবার কোন সময় একটু বেশি ‘ইম্প্রোভাইজ’ করার চেষ্টাও ছিল; কিন্তু সময়ের সাখে সাথে তা বন্ধ হয়েছে। যত বেশি সময় খেলা হয়েছে, লিটন ততই সচেতন হয়ে খেলেছেন।

ডিফেন্স করেছেন বলের লেন্থ দেখে। একটু পিচড আপ, গুডলেন্থে ডেলিভারি যতটা সম্ভব সামনের পায়ে ফরোয়ার্ড খেলেছেন। আর একটু টেনে দেয়া ডেলিভারি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখে পিছনের পায়ে গিয়ে রক্ষণাত্মক ঢংয়ে খেলেছেন।

শট নির্বাচনেও যতটা সম্ভব সতর্ক ও সাবধানী ছিলেন। স্বভাবসূলভ ফ্রি স্ট্রোক প্লে’ না করে পরিবেশ-পরিস্থিতি বিচার করে ঠান্ডা মাথায় বলের মেধা ও গুনাগুণ বিচার করে অবশেষে শতরানের একদম দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন; কিন্তু এরপর নিজের ভুলেই শতরানের নিশ্চিত সুযোগ হাতছাড়া করে বসলেন।

এই উচ্চাভিলাসি শট যে তার ক্যারিয়ারের কত বড় ক্ষতি করছে, মেধা ও সামর্থ্যরে সত্যিকার স্ফুরণ ঘটানোর পথে কত বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে- লিটনের এ বোধোদয় হবে কবে?

এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম