চলমান দশম জাতীয় সংসদের চার বছর পূর্ণ হলো রোববার। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ১১ জানুয়ারি সরকার গঠন করার পর ২৯ জানুয়ারি এই সংসদের পথচলা শুরু হয়। এর আগে ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন হলেও দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি অংশ নেয়নি। জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের আসন গ্রহণ করে। তবে সংসদে বিএনপি না থাকলেও বারবার আক্রমণের শিকার হয়েছে দলটি। আর বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি তেমন ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
Advertisement
তবে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ জাগো নিউজকে বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দলের ভূমিকা আয়নাস্বরূপ। জাতীয় পার্টি সুস্থ ধারার রাজনীতি ও দেশের স্থিতিশীলতায় বিশ্বাসী। সেজন্য সংসদে ও সংসদের বাইরে কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে দলটি ভূমিকা রেখেছে। সরকার যখন কোনক্ষেত্রে লাইনচ্যুত হয় বিরোধী দল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আমি সংসদে সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছি।
সংসদ কাজে ভাটা, মন নেই এমপিদেরজাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রতি মিনিটের গড় ব্যয় ১ লাখ ৬২ হাজার ৪৩৪ টাকা বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক হিসেবে দেখিয়েছে। প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ২৮ মিনিট কোরাম সংকট হচ্ছে। এজন্য সংসদীয় কাজে ঘটছে ব্যাঘাত। কিন্তু এমপিদের সে বিষয়ে মন নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান রোববার জাগো নিউজকে বলেন, সংসদ অধিবেশনের কোরাম সংকটের কোনো উন্নতি হয়নি। সংসদীয় কাজে এমপিদের মনোযোগ কম। তাই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সংসদের আইন শাখা জানায়, এই চার বছরে চলমান অধিবেশনসহ ১৯টি অধিবেশন বসেছে। আর কার্যদিবস ছিল ৩৪২টি। ৪টি বাজেট পাস করেছে সংসদ। প্রথম অধিবেশনে কার্যদিবস ছিল ৩৬টি, দ্বিতীয় অধিবেশনে ২৩টি, তৃতীয় অধিবেশনে ১৪টি, চতুর্থ অধিবেশনে ১০টি, পঞ্চম অধিবেশনে ৩৯ টি, ষষ্ঠ অধিবেশনে ২৬টি , সপ্তম অধিবেশনে ৮টি, অষ্টম অধিবেশনে ১২টি, নবম অধিবেশনে ২৭টি, দশম অধিবেশনে ৯টি, একাদশ অধিবেশনে ৩২টি, ১২তম অধিবেশনে ১০টি, ১৩তম অধিবেশনে ৫টি, ১৪তম অধিবেশনে ৩২টি, ১৫তম অধিবেশনে ৫টি, ১৬তম অধিবেশনে ২৪টি, ১৭তম অধিবেশনে ৫টি, ১৮তম অধিবেশনে ১০ ও চলতি ১৯তম অধিবেশনে রোববার পর্যন্ত ১৫ কার্যদিবস চলেছে। এই চার বছরে মোট ১৩০টি আইন পাস হয়েছে। এসব আইনের মধ্যে অনেক নতুন, মৌলিক ও সংস্কারমূলক আইনও রয়েছে। এর মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ ১৬টি অধিবেশন শেষ করেছে। আর বর্তমানে শীতকালীন অধিবেশন চলছে। সংসদের রেকর্ড যাচাই করে দেখা গেছে, চলতি বছরের এসব বিলের অধিকাংশই পাস হতে ৩০ মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। বিল পাসের প্রক্রিয়ায় বারবার সর্বোচ্চ দশজন এমপিকে অংশ নিতে দেখা গেছে। তবে বেশিরভাগ সময় তাদের দেয়া সংশোধনী গৃহীত হয়নি।
আইন প্রণয়নের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এবার সংসদে সংবিধানের ১৬তম সংশোধন আইন পাস করা হয়। তাছাড়া আরও বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করা হয়। এ আইনগুলোর মধ্যে প্রথম অধিবেশনে ২টি, দ্বিতীয় অধিবেশনে ৬টি, তৃতীয় অধিবেশনে ৫টি, চতুর্থ অধিবেশনে ৬টি, পঞ্চম অধিবেশনে ৮টি, ষষ্ঠ অধিবেশনে ৫টি , সপ্তম অধিবেশনে ৬টি, অষ্টম অধিবেশনে ১০টি, নবম অধিবেশনে ৯টি ,দশম অধিবেশনে ১৪টি, একাদশ অধিবেশনে ১৬টি, ১২তম অধিবেশনে ৬টি, ১৩তম অধিবেশনে ৫টি, ১৪তম অধিবেশনে ৬টি, ১৫তম অধিবেশনে ২টি, ১৬তম অধিবেশনে ৭টি, ১৭তম অধিবেশনে ২টি, ১৮ তম অধিবেশনে ৩টি ও চলতি ১৯তম অধিবেশনে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৮টি আইন পাস হয়েছে।
Advertisement
এই সংসদেই ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী। এছাড়া কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তবে মেয়াদ শেষ হয়েছে দুজনেরই। বিদেশে সুনাম অর্জন করলেও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত এই সংসদ তেমনভাবে কার্যকর হয়নি। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় সংসদীয় কাজে ভাটা পড়েছে। দশম জাতীয় সংসদ গঠনের পর থেকেই সংসদ চলছে ঢিমেতালে। তবে সংসদে না থাকলেও আক্রমণের শিকার হচ্ছে বিএনপি। আর সংসদীয় কমিটিগুলো প্রকৃতপক্ষে কার্যকর হতে পারেনি। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি মেনে একটি ছাড়া আর কোনো সংসদীয় কমিটিই বৈঠক করেনি।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর সরকারের ওয়াচ ডগ হিসেবে কাজ করার কথা থাকলেও আসলে তা হয়নি। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, প্রত্যেকটি সংসদীয় কমিটির মাসে কমপক্ষে একটি করে বৈঠক করা বাধ্যবাধকতা হলেও কোনো সংসদীয় কমিটিই তা গ্রাহ্য করেনি। বিএনপি সংসদে না থাকলেও প্রতিটি অধিবেশনে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবার নিয়ে বিশদ আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। এখনও লাগামহীনভাবে চলেছে সেই সমালোচনা।
সংসদীয় কমিটির কার্যক্রমে ভাটাসংসদের কার্যপ্রণালি অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির মাসে অন্তত একটি করে বৈঠকের নির্দেশনা থাকলেও একমাত্র নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি ছাড়া আর কেউ তা পূরণ করতে পারেনি। তবে প্রতি মাসে বৈঠক অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি চার বছরে সর্বোচ্চ ৭৪টি বৈঠক করেছে।
কার্যকর ও প্রাণবন্ত হয়নি সংসদসরকার ও বিরোধীদল সংসদ কার্যকর ও প্রাণবন্ত রাখার ঘোষণা দিলেও অধিবেশনগুলোতে কোরাম সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দশম সংসদের একাদশতম এই অধিবেশনের প্রায় প্রতিটি দিনেই নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু করতে হয়েছে। বিশেষ করে মাগরিবের নামাজের বিরতির পর আরো সঙ্কটাপূর্ণ অবস্থায় পড়তে হয়েছে সংসদকে।
Advertisement
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন )সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে থাকলেও কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ ছিল। বিরোধী দলহীন সংসদ কার্যকর হয় না। এবারও তাই হয়েছে।
এসব বিষয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান সংসদ অত্যন্ত প্রাণবন্ত। বিরোধী দলের ভূমিকাও ভালো। কখনও কখনও বিভিন্ন কারণে কোরাম সংকট হয়, তবে আগের চেয়ে তা কমে গেছে। সংসদীয় কমিটির বৈঠক সম্পর্কে তিনি বলেন, কমিটিগুলোর নিয়মিত বৈঠক করা উচিত। সরকারের কর্মকাণ্ড গতিশীল করতে সংসদীয় কমিটিকে আরও বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে জাতীয় সংসদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গৌরবের বছর ছিল বিগত বছর। বিশ্ব দরবারে নিজেদের দক্ষতা, একাগ্রতা ও দলভিক্তিক কাজের মাধ্যমে সমীহ আদায়ের বছর। বর্তমান সংসদ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ‘বিতর্ক’ থাকলেও এমপিদের বিশ্ব ফোরামের দুটি সফল ও কার্যকরী সম্মেলন করে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে সংসদ। সংসদের এই দুটি উদ্যোগ বাংলাদেশকে ‘ভাসিয়েছে’ প্রশংসার বানে। এই দুই সম্মেলনে ২০১১ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। আইপিইউ সম্মেলনে ‘ঢাকা ঘোষণা’ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিদায়ী বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত হয় ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ)১৩৬তম সম্মেলন। বাংলাদেশের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সবচেয়ে বড় এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে ফোরামের ১৭১ সদস্য দেশের মধ্যে ১৩২টি অংশ নেয়। মোট ১ হাজার ৩৯৮ জন বিভিন্ন দেশের স্পিকার ডেপুটি স্পিকার, এমপি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বৈষম্য কমাতে ৫ দফা ‘ঢাকা ঘোষণা’র মাধ্যমে শেষ হয় পাঁচদিনব্যাপী এই মহারণের। এই সময় আইপিইউ প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশের আরেক কীর্তিমান এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী। আর নিয়ম অনুযায়ী এই সম্মেলনের সাধারণ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরব ছিল সিপিএ সম্মেলনকমনওয়েথভুক্ত দেশগুলোর সংসদীয় ফোরাম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের ৬৩তম সাধারণ সম্মেলনও দারুণ দক্ষতা ও সুনিপুণভাবে শেষ করে জাতীয় সংসদ। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত সাতদিনব্যাপী এই সম্মেলনের জন্য কঠোর শ্রম দেন জাতীয় সংসদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
ঢাকায় ১ নভেম্বর সিপিএ সম্মেলন শুরু হয়। সিপিএ’র ৫২টি দেশের মধ্যে ৪৪টি দেশ ও ১৮০টি শাখার মধ্যে ১১৪টি শাখা এবারের সম্মেলনে অংশ নেয়। এসব দেশের জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদের ৫৬ জন স্পিকার, ২৩ জন ডেপুটি স্পিকার এবং সংসদ সদস্যসহ ৬১৩ জনপ্রতিনিধি বাংলাদেশে আসেন। সম্মেলনে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিঃশর্তভাবে দ্রুত মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে একটি বিবৃতি গৃহীত হয়েছে। এছাড়া এই সম্মেলনে পরবর্তী তিন বছরের জন্য নতুন চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন।
এইচএস/ওআর