উৎসব যে কোনো জাতি বা সংস্কৃতির মানুষের কাছে প্রাণের খোরাক, তা সে উৎসব ধর্মীয়, প্রথাগত, অথবা সংস্কৃতিগত, যাই হোক না কেন। উৎসব আনন্দে সবাই যেন এখন এক ও অভিন্ন। বাৎসরিক এই উৎসবগুলোতে মিলনমেলায় মেতে ওঠার জন্য সারাবছর ধরে মানুষ যেন উন্মুখ হয়ে থাকে । একাকী জীবনের নিঃসঙ্গতা ও একঘেয়েমি দূর করে সমষ্টিগতভাবে আনন্দ ভাগাভাগি করে মেতে ওঠার জন্য কর্মক্লান্ত মানুষ সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকে। যদিও প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং বিশ্বায়নের ফলে মানুষ এখন আর আগের মত নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক গণ্ডির মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে চাচ্ছেনা এবং পারছেও না। তাই সকল উৎসবেই সবাই এখন সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের উৎসবগুলো এখন ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে ।ঈদ উল ফিতর বাংলাদেশের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসব । আর এই উৎসবকে ঘিরে কত ধরনেরই না আনন্দ আয়োজন, কেনাকাটা, আর সাজসজ্জার ঘনঘটা! আর এই উৎসব ঘনিয়ে আসলেই আনন্দের সাথে সাথে দুর্ঘটনাগুলোও যেন ছায়ার মতো অনুসরণ করে প্রতিটি বছরই। আর ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবার জন্য শহর কেন্দ্রিক মানুষগুলো মরিয়া হয়ে ওঠে, যা অনৈতিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর সারা বছরের উপার্জন । তাই এই সময়ে এরা অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে বাস ট্রেন ও লঞ্চের ভারসাম্য নষ্ট করে। এর ফলে অবধারিকভাবে ঘটে দুর্ঘটনা। গত বছর পিনাক-৬ এর মতো একটি অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত লঞ্চ দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি এখনও বেদনাহত করে মানুষজনকে ।ক্যাপাসিটির তুলনায় অতিরিক্ত লোক বোঝাই করার কারণেই শত শত মানুষ প্রাণ হারায় সেই ঘটনায় । আর আমরা বসে বসে মোবাইল ফোনের ভিডিওতে দেখলাম, মানুষ ডুবে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে । আক্ষেপ আর আহাজারি করা ছাড়া আমাদের কিছু করার থাকলো না। ঈদ আসলেই দূরপাল্লার বাসগুলোও অতিরিক্ত যাত্রিী উঠানোর প্রতিযোগিতায় নামে। শুধু যাত্রী তোলাই নয় কার আগে কে যাবে এ নিয়েও অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এ কারণে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে দূরপাল্লার বাস। দ্রুতগতির বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে গেছে- এরকম খবরের সাথে শুনতে হয় অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির খবরও । বাস উল্টানোর ঘটনার পর জানা যায় যে চালক আসলে চালক ছিলোনা। সে ছিল বাসের হেল্পার । ঈদের সময় ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে, কিংবা বেশি ভাড়া দিতে না পেরে কিছু মানুষ ছাঁদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অনেক সময় একহাতে ঝুলতে থাকে কিছু মানুষ। হাত ছুটে গিয়ে অনেক সময় ট্রেনের নিচে কাঁটা পরে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় পতিত হন তারা । অন্যদিকে বাংলার বইমেলা সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মিলন মেলা । এই মেলায় অংশগ্রহণ করতে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসে জীবন হারালেন বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়। ধর্মান্ধরা তাকে খুন করার জন্য বইমেলার নিরাপত্তাহীনতাকেই বেছে নিয়েছিলো । এই বইমেলায়ই আমরা হারিয়েছি প্রথাবিরোধী বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ূন আজাদ স্যারকে। ঠিক একইভাবে খুনিরা তাদের জিঘাংসা চরিতার্থ করে। আর এবারের ঘটে যাওয়া বৈশাখী মেলায় নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা আমরা কি কখনো ভুলে যেতে পারবো? থার্টি ফার্স্টে টিএসসিতে বাঁধন নামের একটি মেয়ের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক কি কখনোই ভুলতে পারবে ? ভারতীয় টিভি সিরিয়াল “বোঝেনা সে বোঝেনা নাটকের ‘পাখি ড্রেসকে’ কেন্দ্র করে গত ঈদে কতগুলো কোমলমতি কিশোরী আত্মহত্যা করলো । ঘটলো ডিভোর্সের মতো ঘটনাও । পাখির পর এবারের ক্রেজ কিরণমালা । না জানি এবার কিরণমালার জন্য আবার কতজন আত্মাহুতি দেয় !`নূরানি জর্দা, ময়মনসিংহের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম । গত সপ্তাহে এখানে জাকাতের ২০০ টাকার শাড়ি পাওয়ার আশায় লাইনে দাঁড়িয়ে পদদলিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ২৭ জন হতদরিদ্র মানুষ । কিন্তু জাকাতের কাপড় সংগ্রহের জন্য পদদলিত হয়ে প্রাণ হারানোর ঘটনা কি আমাদের দেশে নতুন ? তাহলে আমরা কেন এই ধরনের মৃত্যু এড়াতে পারছি না। মূলত এসব ঘটনাগুলোর সবগুলোর পেছনেই রয়েছে প্রতিযোগিতামূলকভাবে ব্যবসাসফল হওয়ার অদম্য লোভ, যার দায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবেই ব্যাবসায়ীর একান্তই নিজের। জাকাতের নামে ধর্মকে পুঁজি করে পণ্যের প্রচারণা, জনপ্রিয় সিরিয়ালের নামের সাথে মিল রেখে পোশাকের নামকরণ করা, এই সব ঘটনাগুলোই অসাধু, নৈতিকতাহীন ব্যবসায়ীর লাগামহীন লোভের প্রতিফলন,যাকে আমরা নির্দ্বিধায় এবং অবশ্যই হত্যাকাণ্ড বলতে পারি। আর এগুলো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড না হলেও, অবশ্যই অবহেলিত, নিগৃহীত এবং অসতর্কতামূলক, যা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনা করা হলে এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তির হাত থেকে হয়তো রক্ষা পাওয়া যেতো।তাই আর সময় ক্ষেপণ নয়। সময় এসেছে আনন্দের উৎসবগুলোকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রদান করার। প্রয়োজনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে ‘উৎসব ব্যবস্থাপনা সেল’ গঠন করে অনতিবিলম্বে, যথাযথ কার্যকরী ব্যবস্থ্যা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে এই লঞ্চডুবি, পদদলিত হয়ে প্রাণ হারানো, নিরাপত্তার অভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যা আর আত্মহত্যার ঘটনাগুলো আর কোনোদিন আমাদের দেখতে হবে না । শামিম তালুকদার এখন রিমান্ডে । হয়তো জেল জরিমানাও হবে তার। কিছুদিন পর আবার হয়তো দেখা যাবে দায়মুক্তির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কিছু টাকা বিলিয়ে দিচ্ছেন মিডিয়াকে সাক্ষী রেখে । আর অনাহারী মানুষগুলোও আস্তে আস্তে মেনে নেবে প্রিয়জন হারানোর বেদনা ।কিন্তু এভাবে আর কতোদিন?লেখক : আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স এর প্রশিক্ষকএইচআর/পিআর
Advertisement