মতামত

এ আগুন নিভে যাক, নিভে যাক

সময় তার আপন নিয়মে এগিয়ে যায়। তবুও সময়ের সাথে পাল্লা দিতে গিয়েই তাকে আমরা সেকেন্ড থেকে শুরু করে দিন, মাস, বছর, যুগ এমন রকম নানা ভাগে ভাগ করেছি আমাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নামক যাপিত জীবনের সহজ সমীকরণের হিসেব মিলাতে গিয়ে। এভাবেই বছর যায়। বছর আসে।

Advertisement

যেহেতু আমাদের সকল কাজকর্ম ইংরেজি বছরের সাথে সাথে চলমান থাকে ফলে নতুন বছরের যে উপহারটি আমার কাছে বর্তমান সময়ে শ্রেষ্ঠ মনে হয় তা হচ্ছে—কচিকাঁচা ছেলেমেয়েদের হাতে নতুন বছরের শুরুতে নতুন বই তুলে দেয়ার যে অদম্য কর্মযজ্ঞ সেটাকেই। আর বিগত বছরে কোনটিকে সবচেয়ে বেশি হতাশাজনক মনে হয়েছে তা এ লেখার শেষে তুলে ধরেছি। প্রত্যাশা করি নতুন বছরে আমার এ হতাশা কেটে যাবে।

আমরা আমাদের ছোটবেলায় নতুন বই হাতে নিয়ে তার গন্ধ নেবার তেমন সৌভাগ্য অর্জন করতে পারিনি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যদিও বা দু-চারটে নতুন বই পেতাম মাধ্যমিক স্কুলে একটিও নয়।কারণ আমাদের সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন বই বিন্যামূল্যে দেয়া হলেও দেখা যেতো তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। ফলে নতুনের সাথে দু’একটা পুরোনো বইও নিতে হতো অনচ্ছিা সত্ত্বেও।

আর মাধ্যমিকের (৬ষ্ঠ -১০ শ্রেণি) সকল বই-ই তো আমাদেরকে কিনতে হতো। ফলে দেখা যেতো আগের ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে পুরোনো বইগুলো পরের ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা অর্থের বিনিময়ে কিনে নিতো।যদি কোনো বই ছিড়ে যাওয়ার কারণে পড়ার উপযুক্ততা হারাতো শুধুমাত্র সে বইগুলোই পরে নতুন করে কিনতে হতো। কারণ গ্রামের ছেলে-মেয়েদের পক্ষে বেশি টাকা দিয়ে সবগুলো নতুন বই কেনা সম্ভব হতো না। তার মানে আমাদের সময়ে আমরা মূলতঃ পুরোনো বই-ই পড়ার সুযোগ পেতাম। সেটাও আবার অনেকে অর্থাভাবে কিনতে পারতো না।

Advertisement

নতুন বছরের শুরুতে আমাদের যেখানে পুরোনো বই জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হতো সেখানে এখন প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই হাতে পায় –এটা ভাবতেও অসম্ভব ভালো লাগে। মনে হয় এ যেন “আলাদিনের চেরাগ”। কিভাবে এমন বৃহৎ একটা কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা হয় অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা ভাবলে অবাক না হয়ে উপায় থাকে না! ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা গ্রামের রাস্তা ধরে, মেঠো পথ বেয়ে, সরিষা ফুলের হলুদ মেখে, দূর্বা ঘাসের আদর নিয়ে যখন দলবেঁধে স্কুলে যায় সেটা সত্যিই এক অপার্থিব দৃশ্য বলে আমার কাছে মনে হয়। শহরে অবশ্য এমনটা ভাবা যায় না।

এখন স্কুলে স্যারেরা ওদেরকে শারীরিক কোনে শাস্তি দেন না। অযথা ধমক ধামকও দেন না। ফলে তারা খুশি খুশি মনে স্কুলে যায় আবার সেভাবেই বাড়িতে ফিরে আসে— এটা অকল্পনীয় একটা ব্যাপার। অকল্পনীয় বলছি এ কারণে যে আমাদের সময়ে স্কুলে গিয়ে স্যারের হাতে মারধর না খেলে নাকি মানুষ হওয়া যায় না—এমন ধারনাণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো। যে সমস্ত স্যারেরা স্কুলে ছেলে-মেয়েদেরকে শাস্তি দিতেন তাদেরকে সবাই ‘ভালো’ এবং ‘কড়া’ শিক্ষক হিসেবে গণ্য করতেন।

সে ধারণা আজ আমূল পাল্টে গেছে। এখন ছেলে-মেয়েদেরকে দেয়া শারীরিক বা মানসিক শাস্তিকে রীতিমতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এমন আইনের প্রয়োগ যখন সত্যি সত্যি দেখি তখন ছেলেবেলায় স্কুল ছেড়ে চলে যাওয়া আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহপাঠী লতিফের কথা মনে পড়ে যায়। শুধূমাত্র আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের নিষ্ঠুর মারপিটের শিকারে ভীত হয়ে লতিফ সেই যে ২য় শ্রেণিতে থাকতে স্কুল ছেড়েছিলো আর কোনদিন সে স্কুলে ফিরে আসেনি। অনেক বার বলেও তাকে আর কোনদিন স্কুলে ফিরিয়ে আনা যায়নি।এখন সে ভ্যান চালিয়ে জীবন ও জীবিকা চালায়। জানি না হয়ত সেদিন যদি ও এমন শারীরিক শাস্তি না পেতো তাহলে ওর জীবনটা অন্যরকমও হতে পারতো হয়তো। আমাদের বাড়ির পাশে স্বপনদাও এমনি একজন। যে হাতুড়ি দিয়ে স্কুলে ঘন্টা পেটানো হতো তা ওর কপালে ঠুকে দেয়ার পরে ও আর কোনদিন স্কুলমুখো হয়নি।

আমাদের প্রায় শতভাগ ছেলে-মেয়ে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। মাধ্যমিক থেকে তারা ঝরে পড়ে। কলেজে এবং পরবর্তী ধাপে সে ঝরে পড়ার হার আরো বেড়ে যায়। কিভাবে তাদেরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধরে রাখা যায় সে ব্যাপারে নতুন বছরে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে হবে। আমার মনে হয় ঝরে পড়ার এ হারকে বিচেনায় নিয়ে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কারিগরী শিক্ষার উপরে বেশি বেশি জোর দেয়া উচিত। ৮ম শ্রেণি অবধি প্রাথমিক শিক্ষার যে প্রস্তাবনা সেটাকে বাধ্যতামূলক করে নবম শ্রেণি থেকেই কারিগরী শিক্ষা গ্রহণকে উৎসাহিত করতে হবে; যেন একজন ছেলে-মেয়ে তার কর্মজীবনে বেকার না থাকে। সমাজের এবং রাষ্ট্রের জন্য সে যেন বোঝা হয়ে না ওঠে। কারণ, সবার জন্য উচ্চশিক্ষা প্রদান করা উন্নত রাষ্ট্রের পক্ষেও সম্ভব নয়।

Advertisement

তবে, দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এই যে বছরের শুরুতেই ছেলে-মেয়েদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার যে কর্মযজ্ঞ তার সুফল কি আমরা সত্যি সত্যি পাচ্ছি? ছেলে-মেয়েরা কি আসলেই বিদ্যালয় এবং বইমুখি হচ্ছে? নাকি গাইড বই এবং কোচিং এর উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে? তারা এখন সত্যিকারের শিক্ষা পাচ্ছে নাকি জিপিএ নির্ভর সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষা নিতে বেশি উদগ্রীব হচ্ছে? এ বিতর্ক এখন বেশ জোরেশোরে চলছে। আর এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে মনে হয় না খুব বেশি বেগ পেতে হবে।

জিপিএ নির্ভর সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষার বলি হয়ে ছেলে-মেয়েদের সাথে অভিভাবকবৃন্দও আজ নীতি নৈতিকতা হারাতে বসেছেন। ১ম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নও এবার নাকি ফাঁস হয়েছে! কারা এ প্রশ্ন ফাঁস করেছে? আর কারা তা কিনেছে? যারা এ প্রশ্ন কিনে তার উত্তর তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষার হলে নিয়ে এসেছেন সত্যিই কি তারা ভালো মানুষ? ভালো অভিভাবক? এ প্রশ্ন না করে উপায় নেই।

পিইসি, জেএসসি থেকে শুরু করে সকল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, বিসিএস এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়মিতভাবে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে নানা কথা, পরিকল্পনার কথা শুনতে পাই নিয়মিত। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। যদি প্রশ্ন ফাঁস চিরতরে বন্ধ না করা যায় তাহলে সমাজে নৈতিকতাহীনতার প্রসার হবে। সমাজ উচ্ছন্নে যাবে।ভালো মানুষের পরাজয় হবে এবং অন্ধকারের শক্তি সহজেই জেঁকে বসবে।

তাই, বছরের শুরুতে পাঠ্যবই ছেলে-মেয়েদের হাতে তুলে দেয়ার মহৎ কর্মযজ্ঞটি যেন কোনভাবেই কিছু চিহ্নিত দুষ্কৃতকারী, দুর্নীতিবাজ, বিবেকহীন মানুষের কালো থাবার কারণে প্রশ্নফাঁস নামক ভয়াবহ দাবানলের কাছে অসহায় হয়ে না পড়ে— নতুন বছরে সেটাই হোক আমাদের একমাত্র চাওয়া।

লেখক : শিক্ষক ও চিকিৎসক।

এইচআর/জেআইএম