বিশেষ প্রতিবেদন

খেলাপি ঋণে ব্যাংকগুলো উদ্বেগ বাড়িয়েছে

রাজনৈতিক কারণেই ব্যাংক খাতে চরম দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, লেখক-গবেষক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ এ সচিবের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতি, অর্থনীতি, উন্নয়ন ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা নিয়ে মুখোমুখি হয় জাগো নিউজ। ব্যাংক খাতের দুরবস্থা ও তার কারণ নিয়েও নিজের মত ব্যক্ত করেন তিনি। জানান, সুশাসনের অভাবেই আর্থিক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি বিরাজ করছে।

Advertisement

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজ’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারে আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব-

জাগো নিউজ : খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংকগুলো। খেলাপি ঋণ বাড়ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও। কিভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন ব্যাংকের এ পরিস্থিতি?

আকবর আলি খান : খেলাপি ঋণে ব্যাংকগুলো উদ্বেগ বাড়িয়েছে। আমাদের জন্য এটি দুর্ভাগ্য বলেই মনে করি। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও সাইফুর রহমান খেলাপি ঋণরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। অথচ তাদের ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। ব্যাংক পরিস্থিতিও অত্যন্ত উদ্বেগ বাড়িয়েছে। স্পষ্টতই সরকারি ব্যাংকগুলোর যে লোকসান, তা ক্রমশই বেড়ে চলেছে।

Advertisement

জাগো নিউজ : এ পরিস্থিতির জন্য বিশেষত কোন বিষয়কে দায়ী করবেন?

আকবর আলি খান : ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের যে সদস্যরা আছেন, তারা কেউই ব্যাংক পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তারা রাজনীতিবিদ। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি চাইলেই ব্যাংক পরিচালনা করতে পারেন না, যেমন একজন ব্যাংকার চাইলেই রাজনীতিতে ভালো করতে পারেন না। জাগো নিউজ : তাহলে প্রধানত রাজনৈতিক বিবেচনাই দায়ী?

আকবর আলি খান : হ্যাঁ, রাজনীতির কারণেই ব্যাংক খাতে চরম দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে। যারা ব্যাংকে টাকা রাখছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আপামর জনসাধারণ ব্যাংক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ব্যবস্থা পৃথিবীর কোথাও নেই।

জাগো নিউজ : বেসরকারি ব্যাংকগুলো তো অনেকটাই স্বাধীন। সেখানেও বিশৃঙ্খলা…

Advertisement

আকবর আলি খান : রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই সরকারগুলো বেসরকারি ব্যাংগুলোর অনুমোদন দিয়েছে। এ কারণে ব্যাংকের মালিকরাও স্বল্পমেয়াদী স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সরকারের মতোই। যে কারণে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকগুলোর স্বাধীনতাও একই কারণে পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। ব্যাংকের দুর্নীতি অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।

জাগো নিউজ : এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্ব? আকবর আলি খান : ব্যাংকিং বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর তুলে দেয়া হয়েছিল। বলা হচ্ছিল, সরকারের কাজ ব্যাংকিং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা নয়। ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স অথরিটি আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ওই অথরিটির ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণের কথা। ব্যাংকিং বিভাগ প্রতিষ্ঠা করাই হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংক অথরিটির ক্ষমতা খর্বের জন্য। অন্যথায় এ ব্যাংকিং বিভাগের কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।

জাগো নিউজ : একটি কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে ব্যাংকের আরেকটি কেলেঙ্কারি ঢাকা পড়ছে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের আর্থিক খাত আসলে কোথায় যাচ্ছে?

আকবর আলি খান : ব্যাংকিং খাতের যে পরিস্থিতি যাচ্ছে, তাতে আর্থিক খাত নিয়ে আশাবাদী হওয়ার আপাতত কোনো কারণ নেই। সব ক্ষেত্রেই তো সুশাসনের অভাব রয়েছে। সুশাসনের অভাবেই আর্থিক খাতের এমন অনিয়ম-দুর্নীতি। দুর্নীতি হচ্ছে সর্বত্র। হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দুর্নীতিবাজরা উধাও হচ্ছেন, অথচ বিচার হচ্ছে না, সাজা হচ্ছে না। আরও যেন চুরি করা যায়, তার জন্যই নানা আয়োজন হচ্ছে। জাগো নিউজ : এমন কাঁদা তো সর্বক্ষেত্রে?

আকবর আলি খান : রাষ্ট্রে মাথাভারি প্রশাসন সৃষ্টি করা হচ্ছে। নিচের দিকে কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই। অথচ উপরের দিকে অসংখ্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যাদের কোনো কাজ নেই। এ কারণে সব কর্মকর্তা যদি সৎ-ও হয়, তবুও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়। আর বিলম্বিত সিদ্ধান্ত দুঃশাসনের ভালো ক্ষেত্র তৈরি করে। একজন বিনিয়োগকারী সিঙ্গাপুরে গিয়ে দুই কি তিনদিনের মধ্যে চিঠির জবাব পান। আর আমাদের এখানে ছয় মাসেও জবাব মেলে না। বাংলাদেশে দৃঢ় সুশাসনের প্রতি কোনো অঙ্গীকার নেই। সুশাসন প্রতিষ্টা করতে না পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নানা প্রশ্ন থেকে যাবে। এ কারণে যেকোনো সময় আমাদের প্রবৃদ্ধিতে ধস নামতে পারে।

এএসএস/এসআর/এমএআর/