গওহর নঈম ওয়ারা। ব্র্যাকের দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগের সাবেক পরিচালক। কাজ করছেন শরণার্থী বিষয়েও। সামাজিক ও মানবিক বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ঘুরে এসেছেন সম্প্রতি। কেমন আছেন রোহিঙ্গারা, রোহিঙ্গা সংকটের চ্যালেঞ্জ, সংকট নিরসনে করণীয়- এসব বিষয়ে সম্প্রতি জাগো নিউজের মুখোমখি হন তিনি। সাক্ষাৎকারে গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এই বিশেষজ্ঞ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। দুই পর্বের প্রথমটি আজ প্রকাশিত হলো।
Advertisement
জাগো নিউজ : রোহিঙ্গাপল্লীতে মানবিক বিপর্যয়ের বিস্তৃতি ঘটছে দিন দিন। আপনি গিয়েছিলেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। নিজের অভিজ্ঞতায় কী বলবেন?
গওহর নঈম ওয়ারা : রোহিঙ্গা ইস্যু সবাই সাদা চোখে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। একটি বিষয়ের অবতারণা করি। পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ছে, রোহিঙ্গারা বন কেটে সাবাড় করছে। রান্না করতে গেলে জ্বালানির যোগান লাগবেই। অথচ চালের কুঁড়া সেখানে যোগান দিয়ে সহজেই জ্বালানির চাহিদা পূরণ করা যেত। এটি নিয়ে কারো কোনো ভাবনা নেই। অথচ কুঁড়া রোহিঙ্গাদের মাঝে বিতরণ করলে চালের মূল্যও কমে যেত। বিষয়টি ছোট কিন্তু এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। চালের কুঁড়া সারাদেশ থেকেই সরবরাহ করা সম্ভব।
সবার আগে মনে রাখতে হবে, আগের পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক বিষয় নয়। পূর্বের থেকে এখন প্রায় পাঁচগুণ রোহিঙ্গা এপারে এসেছে। বিপুলসংখ্যক এ রোহিঙ্গাদের একটি ক্যাম্পে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটি কখনও সম্ভব না। অবাস্তব চিন্তা।
Advertisement
জাগো নিউজ : তাহলে কী হবে? একটি ক্যাম্পে আনলেই তো শৃঙ্খলা ফিরবে?
গওহর নঈম ওয়ারা : অনেকগুলো বিকল্প আছে। টেকনাফ-উখিয়ার হোস্ট কমিউনিটির মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ পরিবার রয়েছে। পরিবারগুলোর মধ্যে ১০ লাখ লোকের সহাবস্থান করে দেয়া সম্ভব। এতে জরুরি ভিত্তিতে যে সহায়তা যাচ্ছে তাতে সেখানকার বাড়িগুলো ভালোভাবে তৈরি হতে পারত।
জাগো নিউজ : সম্ভব বলছেন?
গওহর নঈম ওয়ারা : হ্যাঁ, মানবিক বিবেচনা থেকে এটি সম্ভব করে তুলতে হবে। যে পলিথিনের ঘর বানিয়ে তারা থাকছেন, সামান্য ঝড়েই সব উড়ে যাবে। ঝড়ের দিন তো আসছে সামনে। জোড়া-তালির টঙ বানানোর জায়গা করে দিয়ে মনে করা হচ্ছে, আগামীকালই মনে হয় রোহিঙ্গারা চলে যাবে। রোহিঙ্গরা দ্রুত চলে যাবে, এটি অবাস্তব চিন্তা। কোনো পরিকল্পনা নেই। উচিত ছিল আগে থেকে সাইট প্ল্যানিং করে ক্যাম্পগুলো করা।
Advertisement
প্রসাব-পায়খানা করার জায়গা নেই। খাবার পানির ব্যবস্থা নেই। ওই অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানি আরো আগে থেকেই কমে গেছে। ১৯৯২ সালে সেখানে যে লেভেলে পানি পাওয়া যেত, এখন তার অনেক নিচে। উপরিভাগের পানি ব্যবহারের সুযোগ ছিল। পাহাড় থেকে অনেক ছড়া (নালা) নেমে এসেছে। কিন্তু সেগুলোর বেশিরভাগই দখল করেছে ইটভাটার মালিকরা। ছড়াগুলোর গতিপথ পরিবর্তন করে তা দখলে নেয়া হয়েছে। এগুলো দেখার কেউ নেই।
জাগো নিউজ : ‘আগামীকাল-ই রোহিঙ্গারা চলে যাবে’ এমনটি মনে করার কারণেই পরিকল্পনার ঘাটতির কথা বললেন। রোহিঙ্গারা দ্রুত চলে যাবে এমনটি তো মনে করাই উচিত?
গওহর নঈম ওয়ারা : হ্যাঁ, দ্রুত চলে যাবে- এমনটি আশা করাই উচিত। কিন্তু চলে যাবে এটি অলৌকিক আশা।
জাগো নিউজ : যে ব্যবস্থাপনার কথা বলছেন, তাতে রোহিঙ্গাদের এপারে বসবাসের স্থায়ী রূপ পাবে কি না?
গওহর নঈম ওয়ারা : না। স্থায়ীত্বের কোনো বিষয় না। আজ পর্যন্ত আমরা রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন করতে পারিনি। যদি দু’দেশের সরকারের মধ্যে সমঝোতা হয়, তাহলে কিসের ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাব। বলা হচ্ছে, ১০ লাখ রোহিঙ্গা এপারে এসেছে। কয়জনের নিবন্ধন হলো? আগে আসা রোহিঙ্গাদেরও নিবন্ধন হয়নি।
জাগো নিউজ : নিবন্ধনের চেষ্টা তো চলছে?
গওহর নঈম ওয়ারা : অগোছালো ও বিচ্ছিন্নভাবে নিবন্ধন চলছে। নিবন্ধনে জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করা দরকার ছিল। ইউএনএইচআর হচ্ছে শরণার্থীদের অধিকার রক্ষা এবং স্বদেশে ফেরত পাঠানোর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি সংস্থা। ইউএনএইচআর-ই এ নিয়ে দরকষাকষি করে থাকে।
জাগো নিউজ : এর জন্য বিশেষত কাকে দায়ী করবেন?
গওহর নঈম ওয়ারা : এটি আমাদের নির্বুদ্ধিতা। সরকার, এনজিও, জাতিসংঘ, গণমাধ্যমসহ অনেকেই কাজ করছে। কিন্তু পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে সবার মধ্যে। যেমন গণমাধ্যম দু’ধরনের ভূমিকা রাখছে। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানা নেতিবাচাক খবর ছাপা হচ্ছে। তারা মাদক বহন করছেন, অস্ত্র আনতে পারেন, রোহিঙ্গা নারীরা অধিক সন্তান জন্ম দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ আমরা একবারও ভেবে দেখি না, কেন রোহিঙ্গারা বছরের পর বছরে ধরে গর্ভে সন্তান ধারণ করেন। গর্ভে সন্তান না থাকলে রোহিঙ্গা নারীদের সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। রোহিঙ্গা মায়েরাই তা বলছেন। অথচ এগুলো নিয়ে বিস্তর কোনো খবর নেই। সবাই বলছেন, এতগুলো মানুষকে কেন আশ্রয় দেয়া হলো?
পরিকল্পনার ঘাটতির কারণেই রোহিঙ্গা চাপ অধিক মনে হচ্ছে। নিবন্ধন করে আশ্রয় দেয়া হলে সরকার বা প্রশাসনের ওপর অনেক চাপ কমে যেত। কার্ড বা ভাউচার দিয়েই তারা দোকান থেকে খাবার কিনে খেতে পারতেন। আগামীকাল যদি মিয়ানমার সরকার বলে, ঠিক আছে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেব। তাহলে আমরা কিসের ভিত্তিতে ফেরত পাঠাব? নিবন্ধন হচ্ছে কিন্তু সেখানে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে এবং তা খুবই ধীর গতিতে হচ্ছে।
আবার সবাই ফেরত যাবে তাও নয়। ১৯৭১ সালে যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা সবাই ফেরত এসেছেন এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। এখানেও হয়ত তাই ঘটবে।
জাগো নিউজ : আপনি স্থানীয়দের বাড়িতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের কথা বলছেন। নিজেরাই তো দ্বন্দ্বে জড়াই। ঠিক রোহিঙ্গারাও। দু’টি দেশের মানুষ এভাবে সহাবস্থান করতে পারবে?
গওহর নঈম ওয়ারা : আপনি যে আশঙ্কার কথা বললেন, তার বিপরীত দৃষ্টান্তও আছে। অনেকেই প্রতিবেশীকে আশ্রয় দেয়, খাবার দেয়, ভরসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন বছরের পর বছর। ১৯৭১ সালে ত্রিপুরায় স্থানীয় জনগণের চেয়ে বাঙালি শরণার্থী অনেক বেশি ছিল। কিন্তু কেউ কি বলতে পারবে যে স্থানীয় জনগণের কাছে থেকে তারা খারাপ ব্যবহার পেয়েছে?
জাগো নিউজ : তাহলে এখানে কি সহমর্মিতার ঘাটতি রয়েছে?
গওহর নঈম ওয়ারা : আমরা তো সবাই আগে থেকেই বিশ্বাস করে রেখেছি, তারা খারাপ লোক। গণমাধ্যমের খবর দেখেন, ত্রাণকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন, দেখবেন সবাই রোহিঙ্গাদের খারাপ দিকটাই তুলে ধরতে চাইছে।
জাগো নিউজ : কিন্তু আশঙ্কা তো থেকেই যায়?
গওহর নঈম ওয়ারা : জেলখানার মধ্যেও পড়াশোনা, খেলাধুলা, বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। এখানে কী আছে? বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। একমুঠো খেয়েই তো আর জীবন বাঁচে না। আরো অনেক কিছুই থাকে। এ নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। পশুর মতো একটু খাবার দিয়েই দায় শেষ করে দিচ্ছি। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না।
জাগো নিউজ : আপনার মত কী?
গওহর নঈম ওয়ারা : জাতিসংঘকে (ইউএনএইচআর) দায়িত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের বহু অভিজ্ঞ ব্যক্তি জাতিসংঘের হয়ে সারাবিশ্বে কাজ করছেন। তাদের এনে কাজ করানো যেতে পারে এখানে।
বিদেশ থেকে এসে একজন ত্রাণকর্মী দুইশ’ ডলারের হোটেল ভাড়া করে থাকছেন। এসবই ত্রাণের টাকায়। বাংলাদেশে তো অভিজ্ঞ লোকের ঘাটতি নেই। যে টাকা উঠেছে তাতে তিন মাস চলবে বলে বলা হচ্ছে। আমি মনে করি, এক বছরের বেশি সময় চলবে, যদি আমরা বিদেশিদের না পুষি। বিদেশি নয়, রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশিরাই যথেষ্ট।
জাগো নিউজ : ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নে অনেকে স্থানীয়দের কাজে লাগানোর বিষয়ে বলছেন। আপনি কী মনে করেন?
গওহর নঈম ওয়ারা : এটিই উত্তম। ভাষার দূরত্ব সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ায়। স্থানীয়রা জানেন এ সমস্যার সমাধান কীভাবে হতে পারে? তাদের কাজে লাগানো সময়ের দাবি। নরসিংদী থেকে ত্রাণ দিতে গিয়ে নয়জন লোক মারা গেলেন দুর্ঘটনায়। খুবই মর্মান্তিক। এভাবে ত্রাণ দেয়ার তো কোনো দরকার ছিল না। পরিকল্পনা থাকলে খুব সহজেই ত্রাণ পৌঁছে দিতে পারত। জেলা প্রশাসককে পছন্দ না হলে রেডক্রসকে দিত পারত। বরং এভাবে দিতে গিয়ে ত্রাণের চেয়ে খরচই বেশি হয়। এগুলো ভাবনার বিষয়।
নতুন রোহিঙ্গারা ত্রাণ পাচ্ছে না। পুরাতন ও স্থানীয়রাই সব নিয়ে নিচ্ছে। বিশৃঙ্খল অবস্থা থাকার কারণে এমনটি হচ্ছে।
জাগো নিউজ : এই বিশৃঙ্খলার জন্য অধিকসংখ্যক রোহিঙ্গা...
গওহর নঈম ওয়ারা : চিন্তা করলেই সব গুছিয়ে আনা সম্ভব। বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৭১ সালের চেয়ে ভয়াবহ নয়, নিশ্চয়ই। তখন সামাল দেয়া গেলে এখন সম্ভব নয় কেন?
এএসএস/এসআর/এমএআর/বিএ