বিনোদন

গেইম রিটার্নস : হতাশার মধ্যে আশার আলো

বাংলাদেশে অ্যাকশন কিংবা থ্রিলার মুভির দর্শক সবসময়ই বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। সাধারণ মানুষ বিনোদন পেতে অ্যাকশনধর্মী সিনেমা দেখতে প্রেক্ষাগৃহে যান। তবে অ্যাকশনধর্মী মুভির সংজ্ঞাটা বোধহয় এখনো রপ্ত করতে পারেননি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। গত কয়েক দশকে অ্যাকশনধর্মী সিনেমার নামে নায়ক-গুণ্ডা মারামারি, দখল, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি কাহিনি দেখে এসেছি।

Advertisement

এবার কিছুটা গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে রয়েল খান নির্মাণ করলেন ‘গেইম রিটার্নস’ সিনেমাটি। যাকে বলা হয়েছে অ্যাকশন বা থ্রিলারধর্মী ছবি। তবে এটিতে অ্যাকশন পেয়েছি; থ্রিলার তেমন পাইনি। দুই ঘণ্টা আঠারো মিনিট দৈর্ঘ্যরে সিনেমাটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন চিত্রনায়ক নিরব হোসেন। সিনেমার কাহিনিতে পেশাদার খুনে তার সহযোগী চরিত্রে ছিলেন চিত্রনায়িকা লাবণ্য। আর প্রেমিকা চরিত্রে অভিনয় করেছেন তমা মির্জা। অ্যান্টি হিরো চরিত্রে মিশা সওদাগর, ডনসহ একঝাঁক খলনায়ক।

সিনেমার গল্পে দেখা যায়, পেশাদার খুনি নিরব (মায়া) একটি কোম্পানির হয়ে মানুষ খুন করেন। এ কোম্পানির মূলহোতা মিশা সওদাগর (কাইজার)। কোম্পানিটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মতো মানুষ খুন করার কন্টাক্ট নিয়ে থাকেন। সেই কন্টাক্টগুলো বাস্তবায়ন করেন নিরব। আসলে মানুষ খুন করার জন্য পৃথিবীতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনো কোম্পানি গড়ে উঠেছে কি-না আমার জানা নেই। মায়ার সহযোগী শায়না (লাবণ্য) খুন করতে তাকে সাহায্য করার পাশাপাশি মনে-প্রাণে ভালোবাসেন। কিন্তু একসময় তমা মির্জাকে (পায়েল) খুনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মায়াকে। মায়া তাকে খুন করতে ব্যর্থ হন। তার প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।

পায়েলের প্রেমে পড়ে খুন করা বন্ধ করে দেয় মায়া। মিশা সওদাগর তা মেনে নিতে পারেন না। এরই মধ্যে মিশা সওদাগরের ছোটভাই মায়ার গাড়িটি পছন্দ করে ফেলেন। সেটি যে কোনো মূল্যে পেতে চান। এমনকি মায়ার বাসায় গিয়ে হামলা করেন। আক্রান্ত হন মায়া। মায়াকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলে তমা মির্জা খুন হন। প্রেমিকা হারানোর প্রতিশোধ নিতে মিশা সওদাগরের ভাইকে খুন করেন মায়া। এদিকে আবার মায়াকে হত্যা করতে লাবণ্যকে নিযুক্ত করা হয়। একসময়ের প্রেম মায়াকে হারানোর ব্যথায় প্রতিশোধ নিতে বিনামূল্যে খুন করার আশ্বাস দেন লাবণ্য। কিন্তু হত্যা করতে এসে উল্টো তাকে রক্ষা করেন। ত্রিভুজ প্রেমের সূত্রে লাবণ্যকে ধরে নিয়ে আসেন মিশা সওদাগর। তাকে বাঁচাতে আসেন মায়া। অতঃপর ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’। অবশেষে ‘তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো’। এই হলো ‘গেইম রিটার্নস’ ছবির গল্প।

Advertisement

সিনেমাটি দেখে প্রথমেই মনে পড়ে হলিউডের ‘জন উইক-২’ মুভির কথা। সেই সিনেমায় জন উইক পেশাদার খুন ছেড়ে দিয়ে ভালো হতে চায়। তার একটা প্রিয় গাড়ি থাকে। গাড়িটি ভিলেনদের ডেরা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এরপর হত্যাকাণ্ড ছেড়ে নিজের অস্ত্র মাটির নিচে পুঁতে রাখে। জন উইকের নায়িকা মারা যায়। তার স্মৃৃতি নিয়ে পড়ে থাকতে চায়। ভিলেন এসে তাকে অফার দেয়, তাতে রাজি না হওয়ায় জন উইকের ঘর-বাড়িয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। জন উইক আবার খুন-খারাবিতে জড়িয়ে পড়েন। সব শেষে যা হয়- নায়েকের জয় অবশ্যম্ভাবী।

জন উইকের প্রসঙ্গ আনলাম এ কারণেই যে, ‘গেইম রিটার্ন’ দেখে আমি বারবার চলে যাচ্ছিলাম জন উইকের কাছে। কারণ এখানেও নিরব পেশাদার খুনি। খুন করতে গিয়ে ঘটনাক্রমে একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে যান। সেই মেয়ের প্রেমে পড়ে খুন করা ছেড়ে দেন। দূরের একটি বাংলোতে বসবাস শুরু করেন। অস্ত্রগুলো মাটির নিচে লুকিয়ে রাখেন। নিরবের প্রিয় গাড়িটি পছন্দ করেন মিশা সওদাগরের ছোটভাই। এখানে বলে রাখা ভালো, মিশা সওদাগরের ভাইয়ের চরিত্রে একজনের উদয় হওয়া বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। তাকে এরআগে একবারও দেখা যায়নি গল্পের কোথাও। তিনি ফিলিং স্টেশনে নিরবের গাড়িটি দেখে হুট করেই কিনতে চান। প্রশ্ন হচ্ছে- এই গাড়ি কি একটিই তৈরি হয়েছে? তিনি চাইলে তো শো-রুম থেকে কিনে নিতে পারেন। কেন তিনি গাড়িটি পাওয়ার জন্য নিরবের বাসায় হামলা করেন। নিরব ও তমা মির্জাকে মারধর করে গাড়িটি নিয়ে যান। বেশি মারের কারণে নিরবের প্রেমিকা তমা মির্জা (পায়েল) মারা যায়। সেই হত্যার প্রতিশোধ নিতে মায়া নামধারী নিরব আবার ফিরে আসেন খুনের জগতে।

ঘটনায় অ্যাকশন এবং রোমান্সের অপূর্ব সমন¦য় দর্শককে আকৃষ্ট করবে নিশ্চিত। তবে থ্রিলারের বিষয়টি আমি এখনো স্পষ্ট নই। গানের আধিক্য সিনেমার নায়ক-নায়িকার রসায়ন বেশ জমিয়ে তুলেছে। অ্যাকশনধর্মী সিনেমায় রোমান্টিক গানগুলো দর্শককে সিটি বাজাতে উৎসাহ জুগিয়েছে। তবে একনাগারে অ্যাকশনের পর হঠাৎ পুরো মাত্রায় রোমান্সের কারণে দর্শক কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিলেন হয়তো। ‘গেইম রিটার্নস’ ছবির সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো নীরবের অভিনয় আর অ্যাকশন দৃশ্যগুলো।

কাহিনির ক্ষেত্রে কোন একটি সিনেমার ছায়া মোটেই ইউনিক গল্প উপহার দিতে পারে না। যতোগুলো বাড়ির ছাদে বা রুমে প্রবেশ করা হয়েছে, তার কোন পূর্ব দৃশ্য ছিলো না। একজন অ্যাকশন হিরো কতরকমের ঝুঁকি নিতে পারে তা ফুটিয়ে তোলা দরকার ছিলো। মনে হচ্ছিল, সবগুলো ভবনের সিকিউরিটি গার্ড অনুপস্থিত কিংবা অর্থের লোভে ম্যানেজড ছিলেন। নায়ক বলেই বিনা বাধায় যার-তার কক্ষে প্রবেশ করতে পারছেন। গল্পের দুর্বলতা আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে বারবার। ফলে অভিনয়শিল্পীরা তেমন জ্বলে ওঠার সুযোগ পাচ্ছেন না। এই সিনেমার জন্য আরো পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন ছিলো বলে মনে হয়।

Advertisement

অসঙ্গতি আরো ছিলো, নিজের বেডরুমে নায়িকা তমা মির্জা কেডস পরে আছেন এবং আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছিলেন। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের বেডরুমে রাতে কেডস পরে বসে থাকি না। নিরবের সহযোগী খুনি লাবণ্য (শায়না) অভিনয় ভালো করেছেন। তবে সংলাপ থ্রোইংয়ে জড়তা কাটাতে পারেননি। যেন মুখস্ত সংলাপ বলে যাচ্ছেন। এছাড়া এমন একটি অ্যাকশন এবং থ্রিলারধর্মী ছবিতে খুনের নির্দেশনা দিতে খামেভরা চিরকুট কেন ব্যবহার করতে হলো? আধুনিক কত প্রযুক্তি ছিলো। ফোন, ফেসবুক, ইমো, ভাইভার, হোয়াটসআ্যাপ তো ব্যবহার করা যেত। আধুনিক ধারার এমন ছবিতে মারামারিতে লোহা, মুগুর, লাঠির ব্যবহার কতটা যৌক্তিক? বিরতির পর বাকি সময়টুকু কেবলই অ্যাকশন। অযথাই গোলাগুলির দৃশ্য দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। এতোগুলো মিসফায়ার কিসের ইঙ্গিত বহন করে?

তবে আমার যেটা মনে হয়- কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য, নির্মাণ কৌশল আরো সুন্দর হলে এই সিনেমাটি হতে পারতো নিরব হোসেন, তমা মির্জা ও লাবণ্যের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। ছবির গানের কথা, সুর এবং দৃশ্যায়ন ভালো লেগেছে। তবে অসঙ্গতিও রয়েছে। নাচের দৃশ্যে পোশাকে একটু ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। নায়কের পাঞ্জাবির সঙ্গে নায়িকার লেহেঙ্গা জাতীয় পোশাক আর নায়েকের প্যান্ট-শার্টের সঙ্গে নায়িকার শাড়ির ম্যাচিং আমার কাছে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে।

পুরো সিনেমার অর্ধেকজুড়ে প্রেম, অর্ধেকজুড়ে অ্যাকশন, সঙ্গে ত্রিভুজ প্রেম। তাহলে একে রোমান্টিক ছবিও বলা যেতে পারে। ঠিক সেই অর্থে থ্রিলার বলতে পারি না। কারণ থ্রিলার এমন একটি বিশেষ ধরন, যার মূল উপাদান হলো অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং উত্তেজনা। এ ধরনের ছবিগুলোতে সাধারণত গতিময়তা, তেজস্বীতা, উত্তেজনা এবং শ্বাসরুদ্ধকর দ্রুতগতি বিদ্যমান থাকে। থ্রিলার গল্প ভীষণভাবে উত্তেজনা বাড়ায়। এতে থাকে কাহিনির প্রাণবন্ত বিন্যাস, কখনো সূক্ষ্ন ও স্থিরভাবে, আবার কখনো দৃঢ় ও জমাটবদ্ধভাবে, আবার কখনো ভয়ানক দুর্দান্ত গতিতে। থ্রিলার দর্শকদের চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসতে দেয় না, বরং কোন উঁচু পাহাড় থেকে নিচের দিকে ঝুঁলে থাকার অনুভূতির মতো ভয়াবহ উত্তেজনায় সোজা বসিয়ে রাখে।

তবে আশার কথা হচ্ছে- ছবির এন্ডিং আমাদের একটি আভাস দিতে পেরেছে। নির্মাতা চাইলে এর সিক্যুয়াল নির্মাণ করতে পারেন। নায়ক নিরবের পরিশ্রম, মেধা, সাহসিকতা, ফিটনেস কাজে লাগিয়ে নির্মাতাও লাভবান হতে পারেন। গল্পের প্রধান চরিত্র হিসেবে নিরবের অভিনয় সাবলীলতার পরিচয় দিতে পেরেছে। ফলে নিরবের কাছে আমরা আরো অ্যাকশন বা থ্রিলারধর্মী সিনেমা আশা করতেই পারি। শুধু তা-ই নয়, সে সম্ভাবনাও আমরা ‘গেইম রিটার্নস’ সিনেমায় দেখতে পেয়েছি। শুধু কাহিনি, সংলাপ, দৃশ্যায়ন, নির্মাণ কৌশলের দিকে গুরুত্ব দিলেই সম্ভব।

এসইউ/জেআইএম